দেশে সাইবার অপরাধে নারী ও কিশোরীরা বেশি প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে

0
167

টাইমস ডেস্ক :
দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে দেশের সাইবার অপরাধীরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সাইবার অপরাধ-সংক্রান্ত অভিযোগের স্তূপ জমা হচ্ছে। তবে পুরুষের তুলনায় নারীরাই বেশি সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৬৭.৯ শতাংশই নারী। যদিও সাইবার অপরাধ দমনে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে সাইবার ইউনিটও। কিন্তু তারপরও কোনোভাবেই সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বরং বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশুদের হয়রানির অভিযোগ আসছে। দেশ ও বিদেশ থেকে ভুয়া আইডি খুলে নারী ও কিশোরীদের হয়রানি করা হয়। এর মাধ্যমে নারী ও কিশোরীরা নানামুখী প্রতারণার শিকার হচ্ছে। অনেক অপরাধীই নারীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ছবি তুলে সাইবার জগতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ওসব অপরাধীদের ব্যাপারে অনেক সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেও লাভ হচ্ছে না। কারণ অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি পুলিশ বগুড়ায় এক কলেজ ছাত্রকে আটক করেছে। সে ২০ জন নারী ও কিশোরীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তাদের আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। পরে ওই ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা ও গয়না হাতিয়ে নেয়।
সূত্র জানায়, সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগী বেশির ভাগ নারীই (১৬.৩ শতাংশ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে। তাছাড়া অনলাইনে পাঠানো বার্তায় হুমকি পায় ১৪ শতাংশ নারী। ১১.২ শতাংশ নারীর ছবি বিকৃত করে অনলাইনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু হয়রানির শিকার হয়েও ৮০.৬ শতাংশ নারী আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না। ভুক্তভোগীদের মতে, অভিযোগ করে লাভ হবে না কিংবা বিষয়টি গোপন রাখতে হুমকি, হয়রানির ভয় এবং সামাজিক ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য মূলত তারা আইনের আশ্রয় নেয় না। বর্তমানে শুধু পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে (সিআইডি) প্রতিদিন গড়ে সাইবার অপরাধ-সংক্রান্ত ৫০ থেকে ৬০টি অভিযোগ জমা হচ্ছে। এ অবস্থায় পুলিশ বিভাগ থেকে অপরাধ দমনে বিশেষায়িত সাইবার থানা স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের প্রবণতা’ শীর্ষক এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী বর্তমানে ভার্চুয়াল জগৎ ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১১ ধাপে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ৭.৪৪ শতাংশ মানুষ। আবার অনলাইনে কাজ দেয়ার কথা বলে প্রতারণার শিকার হচ্ছে ১.৪০ শতাংশ ব্যবহারকারী। ছবি বিকৃত করে ১৫.৩৫ শতাংশ ব্যবহারকারীর ছবি অনলাইনে প্রচার করা হচ্ছে। তাছাড়া পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ৬.০৫ শতাংশ ব্যবহারকারী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২২.৩৩ শতাংশ মানুষ অপপ্রচার চালাচ্ছে। ০.৪৭ শতাংশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট হ্যাক বা তথ্য চুরি হচ্ছে। ১৫.৩৫ শতাংশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং ও তথ্য চুরি হচ্ছে। অনলাইনে ১৭.৬৭ শতংশ ব্যবহারকারীকে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া ১.৪০ শতাংশ ব্যবহারকারীর ভুয়া আইডি তৈরি হচ্ছে, ই-মেইলের মাধ্যমে তারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সাধারণত ১৮ থেকে শুরু করে ৩০ বছর বয়সীরাই সাইবার অপরাধের শিকার বা ভুক্তভোগী।
এদিকে পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী দেশে সাধারণত ১৩ ধরনের সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটছে। তার মধ্যে রয়েছে পারিবারিক বিদ্বেষ সৃষ্টি, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে বিরোধ তৈরি, উগ্র ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য প্রচার, ইউটিউবে অন্তরঙ্গ ভিডিও ও ছবি আপলোড, ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি, পাসওয়ার্ড বা গোপন নম্বর অনুমান করে আইডি হ্যাক, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইন এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং), অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনলাইন গ্যাম্বলিং (জুয়া)। সাইবার অপরাধ দমনের জন্য বাংলাদেশের যে প্রস্তুতি থাকার কথা ছিল তা নেই। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত রিসোর্স, দক্ষ জনবল এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোরও অভাব রয়েছে। ফলে সাইবার অপরাধকে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট সক্ষমতাও নেই। তবে পুলিশ বিভাগ, সিআইডি এ সংক্রান্ত কার্যক্রম খতিয়ে দেখছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইবার অপরাধ দমনে দরকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তাহলেই সাইবার অপরাধ কমবে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের আরো সতর্ক থাকতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুবুর রহমান জানান, সাইবার থানা করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, যা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সাইবার অপরাধ দমনে এ ধরনের থানা নির্মাণের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। তবে এখনো ভুক্তভোগী যারা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে, তারা স্থানীয় থানায় গিয়ে সাহায্য চাইছে। কিন্তু সাধারণ থানায় কর্মরত সব পুলিশ সদস্য প্রযুক্তিগত বিষয়ে দক্ষ নন। প্রাথমিকভাবে সিআইডি একটি সাইবার থানা দিয়ে যাত্রা শুরু করছে। পরবর্তী সময়ে দেশের অন্য বিভাগেও সাইবার থানা স্থাপন করা হবে। বর্তমানে সিআইডির যে সদস্যরা সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করছে তারা প্রায় সবাই বিদেশে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সাইবার থানা করা হলে সেখানে এই প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্যরাই কাজ করবে।