করোনার সুযোগে ওষুধ উৎপাদক ও দোকানিরা অতিরিক্ত মুনাফায় লিপ্ত

0
177

টাইমস ডেস্ক:
দেশি-বিদেশী উৎপাদকরা করোনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে ওষুধদের দাম। আর খুচরা বিক্রেতারাও কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সর্বাধিক চাহিদাসম্পন্ন ওষুধ বেশি দামে বিক্রিতে পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে করোনার প্রতিষেধক হিসেবে যে ওষুধের নাম এসেছে সেগুলোর দাম ইচ্ছামতো বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ও সাধারণ অনেক ওষুধও দ্বিগুণ-চারগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। করোনাকালে দেশে জীবনরক্ষাকারীসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধের দাম সর্বোপ্র চারগুণ বেড়েছে। সরকার দর নির্ধারণ করে দেয়ার পরও কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুইগুণ। তাতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ রোগীরা। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর এবং ওষুধ বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে ওষুধসহ জীবনরক্ষাকারী পণ্যের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়। গত এপ্রিল থেকে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের চাহিদা দেখা দেয়। ওই সময় নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক মানুষ ঘরে ঘরে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ মজুদ করতে শুরু করে। আর ওই সুযোগকে পুঁজি করে উৎপাদক ও দোকানিরা কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত মুনাফায় নেমে পড়ে। শীত এগিয়ে আসছে। শীতকালে শ্বাসকষ্ট ও ঠা-াজনিত ওষুধের চাহিদা বেড়ে যায়। ওই লক্ষ্যে আগে থেকেই দেশের বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো ওসব ওষুধের সংকট তৈরি করেছে। একই সঙ্গে এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনেও সমস্যা রয়েছে। ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ এখনো কার্যকর থাকায় তার সুযোগ নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। ওই আইনের বলে উৎপাদকরা নিজেরাই ওষুধের দাম নির্ধারণ করে। বর্তমানে অধিকাংশ ওষুধের দাম নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর কিছু ওষুধের ক্ষেত্রে চাহিদা বেশি থাকায় ওষুধ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনার সময়ে স্কাভো-৬, ইভেরা-১২, প্যারাসিটামল, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, অ্যান্টিহিস্টাসিন, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল এবং ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ডি ট্যাবলেট জাতীয় ওষুধের বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় সংকট তৈরি হয়। আর সংকটের কারণে দামও বেড়েছে। করোনা চিকিৎসায় রেমডিসিভির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন এর দাম ৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বিভিন্ন স্থানে সাড়ে ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ফেভিপেরাভিনের নির্ধারিত মূল্য ২০০ টাকা কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। আইভারম্যাকটিনের একটি ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ৫০ টাকা। যদিও এর নির্ধারিত দাম ১০ টাকা। তাছাড়া করোনা-আক্রান্ত্র রোগীদের শরীরের দুর্বলতা কাটাতে চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ওই কারণে বেড়েছে ভিটামিনের দামও। বতমানে ভিটামিনজাতীয় ওষুধের দাম তিন থেকে চারগুণ, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগ ওষুধের দাম দেড় থেকে দ্বিগুণ বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে সর্দিজ্বর, মাথাব্যথা, কাশির ওষুধের দাম। বাদ যায়নি অ্যান্টিবায়োটিক ও রক্তচলাচল স্বাভাবিক করার ওষুধও। এখন বাজারে এক পাতা সি-ভিটের দাম ১০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। এক ফাইল নিউরো-বি ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা, নিউরোক্যাল ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা। এক পাতা জিঙ্ক ট্যাবলেট বিক্রি হতো ৩০ টাকা, এখন বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। হৃদরোগী ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। সেজন্য হৃদরোগের ওষুধ রসুভাস-১০ এর দাম ১৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা, রসুভাস-৫ এর দাম ৮০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০০ টাকা, টোসার ৪০ থেকে ৫০ টাকা। শ্বাসকষ্টের ওষুধ ডক্সিসাইক্লিন, ডক্সিক্যাপ প্রতি পাতার দাম ২০ টাকা হলেও নেয়া হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে ডক্সিসাইক্লিন গ্রুপের ওষুধটির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ ফার্মেসিতে ওই ওষুধ নেই বললেই চলে। কাশির ওষুধ অ্যাডোভাস সিরাপের দাম ৫৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৫ টাকা। অ্যজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের দাম দ্বিগুণ বেড়ে ৩১৫ টাকার স্থালে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। এমনকি মুমূর্ষু রোগীদের রক্তচলাচল ঠিক রাখতে ওরাডক্সান গ্রুপের ইনজেকশন ভায়ল ৩০ টাকার পরিবর্তে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। অথচ আগে এক বক্স ভিটামিন-সি বিক্রি হতো ৪৭২ টাকায়। এখন তা ৮০০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে ৩৬০ টাকার রিকোনিল ২০০ এমজি ৬০০ টাকা, ৪৮০ টাকার মোনাস ১০ এমজি ট্যাবলেট ১০০০ টাকা, ৩১৫ টাকার অ্যাজিথ্রোমাইসিন ৫০০ এমজি ট্যাবলেট ৬০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া প্যারাসিটামল, নাপা, নাপা এক্সট্রা- ৫০০ এমজির এক পাতা আগে ছিল ৮ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা। ফেক্সোফেনাডিল গ্রুপের ওষুধের আগের দাম ৭৫ টাকা হলেও এখন নেয়া হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। মনটিন ১০ এমজি এক পাতা ২১০ থেকে নেয়া হচ্ছে ২৩০ টাকা। মনাস ১০ এমজি প্রতি বক্স ৪১৫ টাকার জায়গায় বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকায়।
এদিকে ওষুধের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে খুচরা দোকানিরা বলছেন, তারা ওষুধের সরবরাহই কম পাচ্ছে। আর উৎপাদকরা দাম বাড়িয়েছে বলে তারাও বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়ালে দোনকানিদের কিছু করার থাকে না। কারণ কোম্পানিগুলোই ওষুধের দাম ঠিক করে। পরে শুধু ভ্যাট নির্ধারণের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে পাঠায়। তাই দাম নির্ধারণে ওষুধ প্রশাসনের কিছু করার থাকে না। তাছাড়া এক কোম্পানি দাম বাড়ালে অন্যরাও বাড়িয়ে দেয়। তবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের দাবি, কোম্পানিগুলো দাম কিছুটা বাড়িয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের তৎপরতায় এখন তা অনেকটাই স্বাভাবিক। দেশে যেন ওষুধের দাম ও প্রাপ্যতা স্বাভাবিক থাকে সেজন্য জানুয়ারি থেকেই ওষুধ উৎপাদকদের সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেয়া হয়।
অন্যদিকে ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শফিউজ্জামান জানান, ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। সেক্ষেত্রে কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে করোনাকালে মানুষ নানা ধরনের ওষুধ কিনে বাসায় রাখতে শুরু করে। ফলে কিছু ওষুধের সংকট তৈরি হয়। এই সুযোগে দোকানিরা দাম বেশি নিতে পারে। তবে কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়ায়নি।
এ প্রসঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান জানান, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে কিছু ওষুধের দাম বেশি ছিল। তবে সার্বিকভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ফেবিপেরাভিন ৪০০ টাকায় বিক্রি হতো। প্রশাসন তার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ২০০ টাকা। রেমডিসিভির বিক্রি হতো ৫ হাজার ৬০০ টাকায়, তার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার টাকা এবং আইভারমেকটিন প্রতি ট্যাবলেট ১০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ওষুধের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিগত ২৮ জানুয়ারি উৎপাদকদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়। তাদের সব ধরনের প্র¯‘তি গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়। ফলে দেশে ওষুধের কোনো ঘাটতি হয়নি।