টিলতায় পড়েছে আমদানিকৃত গ্যাস গ্রিডে নেয়ার পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প

0
175

টাইমস ডেস্ক:
বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গ্যাস গ্রিডে নিতে ১৮১ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প জটিলতায় আটকা পড়েছে। সেজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ আবারো এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। মূলত ঋণদাতার চুক্তি স্বাক্ষর ও কার্যকরে সময়ক্ষেপণ, ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখলে জটিলতা এবং বিলম্ব, দরপত্র প্রক্রিয়ায় ৫ মাস বিলম্ব, ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকে তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতার চুক্তি স্বাক্ষরে অস্বীকৃতির কারণে নির্ধারিত সময় ও ব্যয়ে আমদানি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণকাজ শেষ করা যায়নি। ফলে দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এখনো তিন জেলায় জমি হুকুম দখল সমস্যা রয়েছে। ফলে বাড়তে যাচ্ছে গ্যাসলাইন নির্মাণ প্রকল্পের সময় ও ব্যয়। জ্বালানি ও খনিজ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গ্যাস সঙ্কটের কারণে সরকার বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে। দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা, উৎপাদন ও সরবরাহের মধ্যে ৫০ কোটি ঘনফুট ঘাটতি রয়েছে। আমদানিকৃত গ্যাস খালাসের জন্য মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গ্যাস চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাহিদা পূরণের পর তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হবে। সেজন্য বিগত ২০১৬ সালে এক হাজার ৯৬২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা-বাখরাবাদ পর্যন্ত এক হাজার পিএসআইজি চাপসম্পন্ন ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৮১ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে প্রকল্প শুরু করা হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে একনেকে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের একনেক সভায় দেড় বছর সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্প সমাপ্ত করার প্রস্তাব ২ হাজার ৪৭৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের যতোটা অগ্রগতি হয়েছে তাতে প্রতিদিন জাতীয় গ্রিডে ২২ থেকে ২৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালন করা সম্ভব হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩২০ কোটি ঘনফুট। তার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুট। ফলে দৈনিক ঘাটতি ৫০ কোটি ঘনফুট। আমদানিকৃত গ্যাসে এখন ওই ঘাটতি পূরণ করা হবে। কারণ দেশজ গ্যাস ফিল্ডে উৎপাদিত গ্যাসের মাধ্যমে চাহিদা পূরণের চেষ্টা করতে গিয়ে সীমিত মজুদ দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরে গ্যাস পাওয়া গেলে তার সুফল পেতে আরো ৮ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে। আর দেশের স্থলভাগে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনাও তেমন উজ্জ্বল নয়। এমন অবস্থায় দেশে বর্তমানে জ্বালানি চাহিদা পূরণ ও ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে। তাছাড়া মিয়ানমারসহ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে গ্যাস আমদানির বিষয়টিও সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, আমদানিকৃত ও ভবিষ্যৎ আমদানি সম্ভাবনাময় একশ’ কোটি ঘনফুট গ্যাস থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ এলাকার চাহিদাপূরণের পর উদ্বৃত্ত গ্যাস জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশে সরবরাহ করা হবে। সেজন্য দৈনিক ৮০ কোটি ঘনফুট সঞ্চালন ক্ষমতাসম্পন্ন চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট থেকে ফেনী হয়ে বাখরাবাদ পর্যন্ত ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৮১ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করার কাজ শুরু করা হয়। যার অনুমোদিত ব্যয় এক হাজার ৯৬২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তার মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৭৩৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ঋণ আর সরকারি অর্থায়ন হবে ১ হাজার ২২৪ কোটি ২ লাখ টাকা। এখানে ফেনী, মুহুরী, কালিদাস ও ডাকাতিয়া নদীর ১৩ শ’ মিটার রিভার ক্রসিংসহ ১৮১ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। এখন ওই ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৭৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। যার মধ্যে প্রকল্প ঋণ ৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা কমে ৭৩৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা হয়েছে। ফলে সরকারি খাতে অর্থায়ন ৫১৭ কোটি ৩ লাখ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৭৪৪ কোটি ৩২ লাখ টাকায় দাঁড়ায়।
এদিকে বিগত ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৈদেশিক অর্থায়নের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাথে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও অর্থায়নে সহযোগী প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) সাথে বিলম্বে চুক্তি হয়। ২০১৭ সালের ৮ মে চুক্তি হলেও তা ২০১৭ সালের ৩ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। তাছাড়া ক্রয়ে পুনঃদরপত্র আহ্বানের জন্য ৫ মাস বিলম্ব হয়। প্রকল্পের পাইপলাইন ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকে তৃতীয় সর্বনি¤œ মূল্যায়িত দরদাতাগণ চুক্তি স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে চতুর্থ সর্বনি¤œ মূল্যায়িত দরদাতার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। তার দরমূল ডিপিপির দরের চেয়ে বেশি হওয়াতে প্রথম আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় করা হয়। এডিবির অঙ্গীকার চুক্তি ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি কার্যকর হয়। ফলে পাইপলাইন নির্মাণকাজেও বিলম্ব হয়।
অন্যদিকে সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের পর্যালোচনা সভায় প্রকল্প পরিচালক জানান, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগস্ট পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি ৮৭ দশমিক ২৬ শতাংশ বা ২ হাজার ১৬৩ কোটি ৯২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ডাকাতিয়া, কালিদাস, মুহুরী এবং ফেনী নদী ক্রসিং সম্পন্ন করা হয়েছে। ২৯ ফেব্রুয়ারি আরএলএনজির মাধ্যমে পাইপলাইন কমিশনিং সম্পন্ন হয়েছে। বতর্মানে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে ২২ থেকে ২৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালন করা হচ্ছে। পূর্তকাজের অগ্রগতি হলো তিনটি স্টেশন বাখরাবাদ, বিজরা ও মিরসরাই ভূমি উন্নয়ন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ এবং দু’টি স্টেশনের (বাখরাবাদ ও মিরসরাই) বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সমাপ্ত হবে। টিবিএস এবং মিটারিং স্টেশনের মূল ডিজাইন সম্পন্ন হয়েছে। ঠিকাদার ৯৮ শতাংশ মালামাল উৎপাদন সম্পন্ন করেছে। সাইটগুলোতে বিভিন্ন ফিটিংস মালামাল ৫০ শতাংশ সরবরাহ করা হয়েছে। আর প্রকল্প মেয়াদ আবারো এক বছর বাড়ানোর ব্যাপারে বলা হয়, দু’টি টিবিএস এবং একটি মিটারিং স্টেশন স্থাপনের জন্য বৈদেশিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ভালভিটালিয়া এসপিএ ইতালির সাথে ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওই তিনটি স্টেশন নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার কথা থাকলেও প্রাথমিকভাবে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ভূমি হস্তান্তরে ৫ মাস বিলম্ব হয়। পরে ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে চীনে এবং ডিসেম্বর থেকে ইতালিতে করোনার প্রাদুর্ভাবে মালামাল উৎপাদন ও শিপমেন্টের সব কার্যক্রম ৮ মাস বন্ধ থাকে। তাছাড়া ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ফেনী জেলা প্রশাসন দফতরে ১৮১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের জন্য ৬৮১.৩৮ একর ভূমি হুকুম দখল প্রস্তাব দাখিল করা হয়। কিন্তু চূড়ান্ত প্রাক্কলন ডিসি অফিস তিনটি থেকে এখনো পাওয়া যায়নি। অথচ আগামী ২০২১ সালের আগস্টের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) জানান, প্রকল্পের বাকি সব বাস্তব কাজ ও ভূমি হুকুম দখল কার্যক্রম ২০২১ সালের আগস্টে সম্পন্ন হবে। স্থাপনাগুলো নির্মাণ-পরবর্তী হস্তান্তর, পকল্পের অর্থছাড়করণ, সব বিল ও চূড়ান্ত বিলসমূহ প্রদান এবং অডিট নিষ্পন্নের জন্য আরো ৪ মাসসহ মোট এক বছর লাগবে। তবে সেক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই।