করোনার ডামাঢোলে ডেঙ্গুতে পরিস্থিতি আরো নাজুক হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে

0
284

খুলনাটাইমস এক্সক্লুসিভ: করোনা ভাইরাসের ডামাঢোলের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নাজুক আকার ধারণ করার আশঙ্কা বাড়ছে। কারণ রাজধানীর এডিস মশার উৎস স্থান চিহ্নিত করা এবং ধ্বংসের কাজে স্থবিরতা বিরাজ করছে। চলতি এপ্রিল এবং আগামী মে মাসে তা সঠিকভাবে করতে না পারলে বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন। ইতিমধ্যে বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গুর ঝুঁকি আরো বেড়ে গেছে। বিগত ৭ বছরের মধ্যে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ বা যে কোনো বছরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। দেশের মানুষ গত বছরের ডেঙ্গুর ভয় এখনো কাটাতে পারেনি। মাত্র ৬ মাসে তখন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মারা যায় প্রায় ৩০০ জন। দেশে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হওয়ার পর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) মশকনিধন কর্মীদের দিয়ে জীবাণুনাশক পানি ছিটানোর কারণে মশক নিধন কার্যক্রমে স্থবিরতা শুরু হয়। যা এখনো চলমান রয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীতে ইতিমধ্যে মশার উপদ্রব অনেক বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যে খোদ প্রধানমন্ত্রী ঢাকার দুই মেয়রকে সতর্ক করে মশা নিধনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরালোভাবে পরিচালনা করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ১ ও ২ এপ্রিল মশক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ওই নির্দেশনা দেন। কিন্তু এখনো মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন শুরু হয়নি। রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনই এখনো মশক নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারেনি। কারণ এখন পর্যন্ত ডিএসসিসি ৭৫টি ওয়ার্ডে মাত্র ৪২৪ জন মশকনিধন কর্মী নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অথচ প্রতিটি ওয়ার্ডে নতুন ১০ জন করে ৭৫০ জন কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হলেও এখনো নিয়োগ চূড়ান্ত করা যায়নি। আর কবে নাগাদ তা চূড়ান্ত হবে তাও অনিশ্চিত। আর এডিস মশার প্রজননে কঠিন বর্জ্য বড় কারণ হলেও নিখুঁতভাবে আবর্জনা পরিষ্কার কাজেও পিছিয়ে রয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন।
সূত্র জানায়, নবগঠিত এলাকার বাইরে রাজধানীর ১৩৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে প্রায় ৬ কিলোমিটার জলাশয় রয়েছে। আর নবগঠিত এলাকায়ও অন্তত ৪ কিলোমিটার জলশায় রয়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা ওসব জলাশয়ের মালিক। কিন্তু সঠিকভাবে ওসব জলাশয়ের আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। যে কারণে ওসব জলাশয় মশার বড় প্রজনন স্থানে পরিণত হয়েছে। তার বাইরে রাজধানীতে দুই সিটি কর্পোরেশনের অন্তত ৩০০ কিলোমিটার কার্পেটিং ড্রেন রয়েছে, সেসব ড্রেনও পরিষ্কার করা হয় না বলে মশা প্রজননের বড় উৎস স্থানে পরিণত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মশক নিধন খাতে ডিএনসিসিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর ৫৪টি ওয়ার্ডে ২৭০ জন স্থায়ী, ৫৪ জন মাস্টাররোলভিত্তিক এবং ৫৪০ জন আউট সোর্সিং মশক কর্মী রয়েছে। ওষুধ এবং যন্ত্রপাতি রয়েছে পর্যাপ্ত। আর ডিএসসিসিতে মশক নিয়ন্ত্রণে ৪২৪ জন মশক কর্মী রয়েছে। তার বাইরে ৭৫০ জন মশক কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে দেশে ২৭১ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। গত বছর এই তিন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭৩ জন। আর ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর এই তিন মাসে কেবল ২০১৭ সালে মোট আক্রান্ত ছিল ১১৮ জন, বাকি বছরগুলোতে ওই সংখ্যা ছিল ১০০ জনের নিচে।
সূত্র আরো জানায়, করোনা ভাইরাস শনাক্ত ও রোগী ব্যবস্থাপনায় এখন পুরো দেশই বিশেষভাবে সক্রিয়। সেই তুলনায় ডেঙ্গু ও ফ্লু ব্যবস্থাপনা অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। তবে ডেঙ্গু মোকাবেলায় সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একইতালে এডিস মশার উৎস ধ্বংস করা। তা করতে না পারলে গত বছরের চেয়েও জটিলতা বাড়বে। কারণ করোনার কারণে এখন ঢাকার বেশির ভাগ মানুষই সারা দেশে ছড়িয়ে আছে এবং বেশির ভাগ মানুষই ঘরে থাকছেন। ফলে মশায় কামড়ানো ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
এদিকে অতিসম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বা সংস্থার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করাসহ ১২ দফা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার দুই নগর সংস্থা, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ একযোগে মশক নিধন অভিযান শুরু করবে। আর সরকারি ভবন, লেক, পার্ক, খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মশা মারার কাজ করবে সিটি করপোরেশন। তাছাড়া দীর্ঘ ছুটির সময় বন্ধ থাকা সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলো থেকে এডিস মশার উৎপত্তি যেন না হয় তা নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে মশকনিধন কর্মীরা মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি জীবাণুনাশক পানিও ছিটাচ্ছে। তাতে করে তাদের পরিশ্রম বেশি হচ্ছে। দুটো কাজ একত্রে করতে গিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না তা বলা যাবে না। তাছাড়া গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কর্মীদের বাসা থেকে কর্মস্থলে আসতেও সমস্যা হচ্ছে। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও তাদের নানাভাবে হয়রানি করছে। সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে মশা নিধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. মোমিনুর রহমান মামুন জানান, দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর মশক কর্মীদের মশার ওষুধ ছিটানোর সঙ্গে জীবাণুনাশক স্প্রে করার কাজ করানো হচ্ছিল। তবেগত কয়েক দিন থেকে তাদের দিয়ে শুধু মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। আর সংস্থার অন্যান্য বিভাগের কর্মীদের দিয়ে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। এবার এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকে সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম চলছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা জানান, করোনা মোকাবেলার ব্যস্ততার মধ্যেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বৃষ্টি হলে উদ্বেগ আরো বেড়ে যায়। এমনিতেই করোনা নিয়ে অস্থির অবস্থা চলছে, তার মধ্যে যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বা মশার উৎস ধ্বংসে সঠিকভাবে কাজ করা না যায় তবে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি কাটবে না। তাছাড়া সিজনাল ফ্লু তো আছেই। আর করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া আর ফ্লু যদি একাকার হয়ে এবার দেশে জেঁকে বসে, তবে পরিস্থিতি খুবই জটিল হয়ে উঠবে। তাই সবাইকে এবার সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।