মুক্তিযুদ্ধের গৌরবার্তা খুলনার সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ এমএম সিটি কলেজ

0
123
Basic RGB

কাজী মোতাহার রহমান:
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর উনসত্তরে বাঙালির আর এক দফা বিজয় অর্জিত হয়। বাঙালি নিজেদেরকে লড়াকু জাতি হিসেবে প্রস্তুত করে। পাকিস্তান আমলের শেষ সময়টা খুলনার সামগ্রিক রাজনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। উনসত্তরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পূর্বে এম এম সিটি কলেজে ছাত্র রাজনীতি ছাত্রলীগের অনুক‚লে বইতে থাকে। প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলতে হয় ৬৮ সালের পূর্বে ছাত্রলীগ মনোনীত রূপসার আনন্দনগর গ্রামের মোল্লা মোশারফ হোসেন ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স মুজিব বাহিনী খুলনা জেলা ৭১)। ১৯৬৮-৬৯ সালে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত শেখ শহীদুল ভিপি এবং শেখ আজমল হোসেন জিএস নির্বাচিত হন। ৬৯ এর গণআন্দোলনের সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া ও নির্যাতন নেমে আসে। পূর্ব পাকিস্তান জামানার প্রথম দিকে প্রথম দিকে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ ও ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে। ৫৪’র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব জয় আর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু’র নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়। এ অভ‚তপূর্ব বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ ইয়াহিয়া খান ৭১-এর ৩ মার্চ জাতীয় সংসদে অধিবেশন আহŸান করেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় একাত্তরের ১ মার্চ। সকাল থেকে ইথারে ইথারে খবর ভেসে আসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট রেডিও ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। দুপুর একটা নাগাদ প্রেসিডেন্টের ভাষণের পরিবর্তে রেডিওতে জাতীয় সংসদে ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা প্রচারিত হয়। রেডিওতে পাক প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার প্রতিবাদে খুলনা শহরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছাত্র জনতা জঙ্গি মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে।
১ মার্চ বিএল কলেজে বিএ অনার্স পরীক্ষা চলছিল। রেডিওতে এই ঘোষণার প্রতিবাদে সেখানকার পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা বর্জন করে। বিকেলে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আজম খান কমার্স কলেজ থেকে বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিল মিউনিসিপাল পার্কে এসে শেষ হয়।
মিছিলের শ্লোগান ছিল “জয় বাংলা” “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা”, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। মার্চের প্রথমে শহরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে দেওয়াল লিখনের প্রয়োজন হয়।
ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শহরের আহসান আহমেদ রোডস্থ টিএন্ডটি অফিস (অধুনালপ্ত), পিকচার প্যালেস ভবনের বিপরীতে, নগর ভবন, তৎকালীন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ বাংলাদেশ (আজকের বাংলাদেশ ব্যাংক), খুলনা প্রধান গেটে গভীর রাতে দেওয়াল লিখন হয়। দেওয়ালে শ্লোগান ছিল “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। এতে ছাত্রলীগের সুশান্ত কুমার নন্দী (কমার্স কলেজ), আ ব ম নুরুল আলম (বিএল কলেজ), ইউসুফ আলী ভূঁইয়া, তালুকদার আব্দুল খালেক (সিটি কলেজ), নুরুল ইসলাম খোকন (সিটি কলেজ), শামসুদ্দোহা টিপু প্রমূখ অংশ নেয়।
৩ মার্চ স্বাধীনতার দাবিতে স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল পার্ক (আজকের শহীদ হাদিস পার্ক) থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জঙ্গি মিছিল বের হয়। লোয়ার যশোর রোডস্থ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে বেলুচ পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়।
মিছিলের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, জাতীয় সংসদ সদস্য শেখ আব্দুল আজিজ, সাধারণ সম্পাদক প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হাবিবুর রহমান খান, জাতীয় সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন ইউসুফ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এডভোকেট মমিনউদ্দিন আহমেদ, এডভোকেট এনায়েত আলি সানা, জেলা আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু, বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের ডিপি স. ম বাবর আলী প্রমূখ। ৩ মার্চ বিকেলে ছাত্র সমাজ কালীবাড়ী রোড ও কেডি ঘোষ রোডে কয়েকটি বন্দুকের দোকান লুট করে।
তারা দোকানগুলো থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করে। ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের খুলনা কমিটি গঠন করা হয়।
অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্বর কারণে আহŸায়ক নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। যুগ্ম আহŸায়ক মনোনীত হন যৌথভাবে স. ম. বাবর আলী, হুমায়ুন কবির বালু (সিটি কলেজ)। সদস্যবৃন্দ শেখ আব্দুল কাইয়ুম, শেখ শহিদুল হক (সিটি কলেজ), হায়দার আলী, সালাউদ্দিন রুনু, হেকমত আলী ভূঁইয়া (সিটি কলেজ), শাহ আব্দুল কালাম, ফ.ম সিরাজ, মাহবুবুল আলম হিরন, শেখ শওকত আলী ও মিজানুর রহমান। ছাত্রলীগের ত্যাগী কর্মীদের নিয়ে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনী জিলা স্কুল মাঠে প্রতিদিন বিকেলে স্কুলের ক্যাডেটদের ড্যামি রাইফেল নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। ২৩ মার্চ সকাল ১০টা নাগাদ সাদা পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে জয় বাংলা বাহিনী মিউনিসিপ্যাল পার্কে উপস্থিত হয়।
এ সময় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পতাকা উত্তোলন করা হয়।
খুলনায় এই প্রথম পতাকা উত্তোলন। ফেব্রæয়ারীর শেষ দিকে শহরের স্কুল-কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। খুলনায় পাকিস্তান বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্ণেল শামস। তার নেতৃত্বে স্বাধীনতা প্রত্যাশীদের গ্রেফতারের তালিকা ও হত্যার নীল নকশা তৈরি হয়। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২৬ মার্চ খান জাহান আলী রোডস্থ কবীর মঞ্জিলে (আলিয়া মাদ্রাসার অদূরে) বিপ্লবী পরিষদের কমিটি গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা হচ্ছেন, মোল্লা মোশাররফ হোসেন (সাবেক ভিপি, আনন্দনগর, রূপসা), শেখ জাহিদুর রহমান জাহিদ (বাগমারা), শেখ শহীদুল হক (সাবেক ভিপি, শেখপাড়া), শরীফ খসরুজ্জামান (সাবেক সংসদ সদস্য, নড়াইল)।