দাতাদের অনুদান কমে যাওয়ায় এনজিও কার্যক্রমে বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়ছে

0
174

খুলনা টাইমস: বিশ্বের দাতা সংস্থা ও দেশগুলো বাংলাদেশকে দেয়া অনুদান প্রতিশ্রুতি কমিয়ে দিয়েছে। মূলত পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতায় উন্নতির কারণেই দাতারা এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে অনুদানের প্রতিশ্রুতি আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৬৩ শতাংশ কমেছে। আগামী দিনগুলোয় এর মাত্রা আরো কমার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে দেশে সক্রিয় দাতাদের অনুদাননির্ভর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) ভবিষ্যতে কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে বিপাকে পড়ার আশঙ্কাও দিন দিন তীব্র হচ্ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আগামী কয়েক বছরের জন্য প্রায় ১২০ কোটি ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর ওসব অর্থায়নে নেয়া কার্যক্রমগুলো সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি এনজিওগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সামনের দিনগুলোয় দাতা সংস্থাগুলোর অনুদানে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে ১৫৭ কোটি ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশী মুদ্রায় তার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরে ওই অনুদানের প্রতিশ্রুতি নেমে এসেছে মাত্র ৫৮ কোটি ৩৯ লাখ ৬২ হাজার ডলারে, যা টাকার অংকে দাঁড়ায় মাত্র ৪ হাজার ৯৬৪ কোটি। ওই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে দাতাদের অনুদানের প্রতিশ্রুতি প্রায় ৬২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি প্রকল্প কিংবা কর্মসূচিতে অনুদানের অর্থায়ন কমার তেমন কোনো প্রভাব না পড়লেও এনজিওগুলোর উদ্বেগে বাড়ছে। কারণ দেশের শীর্ষ স্থানীয়নীয় এনজিওগুলোর অর্থায়নের একটি অংশ এখনো অনুদাননির্ভর। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশে বড় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাজ্য সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)। সরকারি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কিংবা বেসরকারি খাতগুলোর জন্য অনুদানের নির্ভরযোগ্য অর্থায়নের উৎস হিসেবে আস্থাশীল প্রতিষ্ঠান ডিএফআইডি। বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয়নীয় এনজিও ব্র্যাক দেশে ডিএফআইডির অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। ডিএফআইডির কাছ থেকে অনুদানপ্রাপ্তি কমে গেলে ব্র্যাকের অনুদাননির্ভর কার্যক্রমে অর্থায়ন সংকুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। চলতি বছরের মার্চেই ব্র্যাকের সঙ্গে ডিএফআইডির ৫ বছরের কৌশলগত চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এ অবস্থায় সংস্থাটি ডিএফআইডির সঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বেশ উদ্বেগে রয়েছে।
সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনুদানের প্রতিশ্রুতি কমে আসাটাকেই স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছে। আর সামনের দিনগুলোয় দেশে অনুদানের পরিমাণ আরো কমবে। তবে কভিড পরি¯ি’তিতে হয়তো বাংলাদেশ আরো অনুদান পেতে পারতো। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশগুলো দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেখেই ঋণ প্রদানে আগ্রহী। তবে অনুদানের অর্থায়ন বন্ধ হলেও তার বিকল্প সব ধরনের উৎস ব্যবহারের উদ্যোগ চালু থাকবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আর্থ-সামাজিক পরি¯ি’তির উন্নয়ন, শিক্ষার মান উন্নয়ন, অপুষ্টির সমস্যা প্রতিরোধ, দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ কিংবা বৈষম্য কমিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচিতে অনুদান দিয়ে থাকে। গত বছরও ইইউ দুটি কর্মসূচিতে ১৪ কোটি ২০ লাখ ইউরো অনুদান দিয়েছিল। তার মধ্যে সরকারি আর্থিক ব্যব¯’াপনার উন্নয়নে ১ কোটি ইউরো ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে ১৩ কোটি ২০ লাখ ইউরো ব্যয় করার কথা। সামনের দিনেও সং¯’াটি থেকে অনুদানের প্রতিশ্রুতি কমার শঙ্কা রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কভিড-১৯ মোকাবেলায় গতবছরের ৭ মে ৫০ কোটি ও ৩০ এপ্রিল ১০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। প্রায় ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে ওই খাতে সং¯’াটি অনুদান দিয়েছে মাত্র ২৯ কোটি টাকা। যদিও এডিবি থেকে বাংলাদেশের বড় ধরনের অনুদানের প্রত্যাশা ছিল। তবে ঝুঁকি ও সক্ষমতা বিবেচনা করেই বাংলাদেশকে এভাবে অর্থায়ন করেছে এডিবি।
এদিকে প্রাথমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা উপখাতের মান, প্রাসঙ্গিকতা ও দক্ষতার উন্নয়নে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-৪ (পিইডিপি-৪) শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হ”েছ। ইইউ ওই প্রকল্পে ২০ কোটি ৫৫ লাখ ইউরো অনুদান দেবে। আর বাজেট সহায়তা হিসেবে ২০ কোটি এবং কর্মসূচিটির পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ও অডিটের জন্য ৫৫ লাখ ইউরো দেবে। সব মিলিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রায় ১ হাজার ৯২৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকার অনুদান দেবে ইইউ। যদিও ওই প্রকল্পে অনুদানের অর্থের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল। সামনের দিনে অনুদানের প্রতিশ্রুতি আরো কমে গেলে ওই ধরনের নতুন প্রকল্পে অর্থায়ন জটিলতা তৈরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া বৈদেশিক অর্থায়নে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রায় ৯০ শতাংশই এসেছিল। কিš‘ বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাওয়ায় অনুদাননির্ভর অর্থায়নের বিষয়টি একেবারেই গৌণ হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ গৃহীত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সং¯’ান হবে প্রায় ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বৈদেশিক অর্থায়নের অবদান থাকবে মাত্র ১১ দশমিক ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে দাতাদের অনুদান কমলেও বাংলাদেশের সক্ষমতা বিবেচনায় ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঋণের প্রতিশ্রুতি ছিল ৮৩৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার ডলার, যা গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯২১ কোটি ৩৯ লাখ ১১ হাজার ডলারে উন্নীত হয়েছে। ফলে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ প্রতিশ্রুতি বেড়েছে প্রায় ৮৭ লাখ ৮৯ হাজার ডলার।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, দেশ এখন বৈদেশিক অনুদানের ওপর এতোটা নির্ভরশীল নয়। নিজেদের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। বৈদেশিক অর্থায়ন ও অনুদানকে একেবারেই নিরুৎসাহিত করা হবে না। বরং কোনো দেশ বা সং¯’া অনুদান দিতে চাইলে সুবিধাজনকভাবে তা গ্রহণ করা হবে।