কেএমপি গোয়েন্দা তালিকায় ৮ থানায় মাদক বিক্রেতা ৬৭৮ জন

0
912

কামরুল হোসেন মনি
মাদকের বিরুদ্ধে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি)’র গোয়েন্দা বিভাগ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। মাদক সেবন ও মাদক পাচার রোধে একের পর এক অভিযান অব্যাহত রেখেছে গোয়েন্দা বাহিনী। আইনের চোখকে ফাঁকি দিতে মাদক বিক্রেতারাও ইয়াবা পাচারের নতুন রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন মানুষের পাকস্থলী। গত ৭ জুন কেএমপি গোয়েন্দা বিভাগের একটি টিম নগরীর বানরগাতী বাজার এলাকা থেকে ইয়াবাসহ একজনকে আটক করে। তিনি পেটের ভেতরে বিশেষ কৌশলে ইয়াবা চালানটি ঢাকা থেকে খুলনায় নিয়ে আসেন। এ ঘটনার পর গোয়েন্দা বিভাগ নিশ্চিত হন যে, মাদক ব্যবসায়ীরা বহনের ক্ষেত্রে ইয়াবা পাচারে নতুন রুট হিসেবে মানুষের পাকস্থলী ব্যবহার করছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পেটের ভেতরে ইয়াবা ঢুকিয়ে বহন করায় যেকোনও সময় বহনকারীর মৃত্যু হতে পারে।
এদিকে কেএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের তালিকা অনুযায়ী ৮ থানায় পুরুষ-মহিলা মিলে ৬৮৭ জন মাদক বিক্রেতা রয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ মাদক ব্যবসায়ীকেই মাদকসহ আটক করেন। পরবর্তীতে জামিনে বেরিয়ে এসে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন আবার অনেকে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। গত দেড় মাসে বিভিন্ন স্থানে গোয়েন্দা বিভাগ মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে ৭৩ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেন। এ সময় ইয়াবা, ফেনসিডিল, মদ ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়।
কেএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার বি এম নূরুজ্জামান (বিপিএম) শনিবার এ প্রতিবেদককে বলেন, বতর্মান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সেই যুদ্ধে আমরা মাঠে রয়েছি। মাদক চোরাকারবারীরা যতই কৌশল অবলম্বন করুক না কেনো আমাদের জালে তারা ধরা পড়বেই। তিনি বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অব্যাহত অভিযান থাকায় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। পেটের ভেতরে বিশেষ কৌশলে ইয়াবা ঢুকিয়ে পাচার করা হচ্ছে। কখনও পলিথিনে পেঁচিয়ে মুখ দিয়ে, কখনও বিশেষ কায়দায় পায়ুপথ দিয়ে ইয়াবা ঢোকানো হয় পেটের ভেতর। পরে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে তা বের করা হয় মলত্যাগের মাধ্যমে। ইয়াবা ব্যবসয়ীরা সাধারণ বহনকারীদের অর্থের লোভ দেখিয়ে প্রানঘাতি এই কৌশলে ইয়াবা বহনে বাধ্য করাচ্ছে। নগরীতে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের মাদকসহ আটক করা হচ্ছে। তারা আবার জামিনে বেরিয়ে এই পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। অনেকে বিভিন্ন উপজেলায় আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদেরকে ধরতে গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক টিম মাঠে রয়েছে। মাদকমুক্ত সমাজ গড়া আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর একার পক্ষে সম্ভব না। তিনি বলেন, মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) অঞ্জন কুমার চক্রবর্তী শনিবার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ একটা বিষয়। পেটের ভেতরে ইয়াবা ঢোকানো হলে যেকোনও সময় মৃত্যু হতে পারে। বিশেষ করে পলিথিনে পেঁচিয়ে ইয়াবা পেটে ঢোকানো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ যেকোনও সময় পলিথিন ফেটে বা লিক হয়ে ইয়াবা পাকস্থলীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পেটের ভেতরে থাকার কারণে পেটের ভেতরের অর্গানগুলোর স্বাভাবিক পরিচালনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
কেএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার বি এম নূরুজ্জামান (বিপিএম) বলেন, চোরাকারবারীদের মধ্যে পেটের ভেতরে করে ইয়াবা পাচার দেখা যাচ্ছে। সাধারণত আগে থেকে নিশ্চিত না হওয়া গেলে এ ধরনের চোরাকারবারীদের ধরা যায় না। কারণ, সাধারণভাবে শরীর বা সঙ্গে থাকা লাগেজ তল্লাশি করে অবৈধ মালামাল চেক করা হয়। কিন্তু পেটের ভেতরে থাকা কোনও দ্রব্য সাধারণ তল্লাশি যন্ত্র দিয়েও শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
কেএমপি গোয়েন্দা বিভাগের সূত্র মতে, তাদের তালিকা অনুযায়ী নগরীর ৮টি থানায় ৬৭৮ জন মাদক বিক্রেতা রয়েছেন। এর মধ্যে দৌলতপুর থানাধীন এলাকায় ১০০ জন, সদর থানাধীন এলাকায় ১২০ জন, সোনাডাঙ্গা মডেল থানাধীন এলাকায় ৯০ জন, খালিশপুর থানাধীন এলাকায় ২০৫ জন, খানজাহান আলী থানাধীন এলাকায় ৪০ জন, আড়ংঘাটা থানাধীন এলাকায় ৪০ জন, লবণচরা থানাধীন এলাকায় ৭৮ জন ও হরিণটানা থানাধীন এলাকায় ২৫ জন মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এরা বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার মাদকসহ আইন শৃৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে আটক হয়েছে। পরবর্র্তীতে জামিনে বেরিয়ে এসে তারা আবারও এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। কেউ বা গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন উপজেলায় গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ইয়াবার ক্ষেত্রে চোরাকারবারীরা পলিথিনে পেঁচিয়ে টিউবের মতো তৈরি করে থাকে। একেকটি টিউবে ৪০০ থেকে ৫০০ ইয়াবা ট্যাবলেট থাকে। এগুলো কখনও কলার ভেতরে ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে গিলে খাওয়া হয়। আবার কখনও বিশেষ কৌশলে মলদ্বার দিয়ে পেটের ভেতরে ঢোকানো হয়। ২০-২৫টি টিউব একসঙ্গে পেটের ভেতরে ঢুকিয়ে বহনকারীরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাত্রা শুরু করে। পথে তারা তল্লাশির মুখোমুখি হলেও তাদের ধরা যায় না।
গত ৬ জুন দুপুরে কেএমপি গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোনাডাঙ্গা মডেল থানাধীন বানারগাতী বাজার এলাকা থেকে মৃত বেলায়েত হোসেনের পুত্র মোঃ সাইদুজ্জামান ওরফে পলাশকে ২৬ পিস ইয়াবাসহ আটক করেন। গ্রেফতারকৃত স্বীকার করেন তিনি অভিনব পন্থা অবলম্বন করে ৩০ মে ঢাকা হতে ইয়াবা ট্যাবলেট লম্বা আকৃতির প্যাকেট তৈরি করে গিলে খেয়ে পেটে বহন করে খুলনায় নিয়ে আসেন। গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি মল ত্যাগের মাধ্যমে ৩৩টি লম্বা আকৃতির প্যাকেট বের করে বিক্রি করেছেন। বাকী ৬টি প্যাকেট তার পেটের মধ্যে আছে। এ কারণে সে অসুস্থ বোধ করলে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কতর্ব্যরত ডাক্তারের পরামর্শে প্রিজন সেলে পুলিশ প্রহরায় ভর্তি করানো হয়। গত ৮ জুন থেকে ১০ জুন পর্যন্ত মল ত্যাগের মাধ্যমে ৬টি প্যাকেট থেকে ২৫৮ পিস গলিত অবস্থায় ইয়াবা ট্যাবলেট বের করা হয়। এছাড়া জুলাই মাসের শেষে দিকে রূপসা ব্রিজের পশ্চিম পাশে সেতু ডিলাক্স নামে একটি বাসে অভিযান চালিয়ে লবণচরা থানা পুলিশের একটি টীম শাহজাহান জোমাদ্দার (৩৫) ও মোঃ তাজুল মিনা (২০) নামে দুইজনকে গ্রেফতার করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, তাদের পেটে ইয়াবা রয়েছে। বিশেষ পদ্ধতিতে তাদের মল ত্যাগের মাধ্যমে ১৪৩টি ক্যাপসুল উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি বায়ুরোধক ক্যাপসুলে ৫০টি করে ইয়াবা পাওয়া যায়। দু’জনের পেট থেকে মোট ৭১৫০ পিস ইয়াবা বের করে পুলিশ। এর আগেও তারা এভাবে ইয়াবার চালান নগরীতে এনেছিলেন বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ জানা গেছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় গ্রেফতারকৃত শাহজাহান ও তাজুল শনিবার বিকেলে কক্সবাজার থেকে খুলনার উদ্দেশে ইয়াবার চালান নিয়ে আসে। রোববার বিকেলে তারা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেন তাদের পেটে ইয়াবা রয়েছে। ইয়াবার চালান তারা এর আগেও খুলনায় এনেছিলেন। গ্রেফতারকৃত শাহজাহান মাগুরা জেলার ভাঙ্গড়া এলাকার মৃত রশিদ জমাদ্দারের পুত্র এবং তাজুল নড়াইল জেলার কালিয়া থানার ফালুদা গ্রামের মৃত হাবিব মিনার পুত্র।