করোনা প্রাদুর্ভাবে চলমান লকডাউনে চরম সঙ্কটে স্থানীয় বাজারের পণ্য উৎপাদকরা

0
146

টাইমস ডেক্স: করোনা সংক্রমণ গত বছরের মতো এবারো ঈদ মৌসুমে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে স্থানীয় বাজারের পণ্য উৎপাদকরা। লকডাউনে দোকানপাট সব বন্ধ থাকায় অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে রড, সিমেন্ট, বস্ত্র, আসবাবপত্র, পাদুকাসহ নানা ধরনের পণ্যের বাজার। বর্তমানে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সরকার কারখানা চালু রাখার সুযোগ দিলেও তা আদৌ কোনো কাজে আসবে কিনা তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের সন্দিহান। তাদের মতে, যারা পণ্য বিক্রি করবে তাদের দোকানপাট বন্ধ। ফলে কারখানায় উৎপাদন করলেও তা বাজারে পৌঁছানো যাবে না, বিক্রিও হবে না। দেশের বস্ত্রকলগুলো স্থানীয় বাজারে প্রায় শতভাগ কাপড়ের চাহিদা মেটায়। বর্তমানে দেশজুড়ে ছোট-বড় ৩ হাজার বস্ত্রকল রয়েছে আর ওই খাতে কয়েক লাখ শ্রমিক কাজ করে। সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধে দেশী বস্ত্রকলগুলো ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ঈদের আগে এই সময়েই কাপড়ের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে। সারাদেশের বস্ত্রকলগুলো থেকে কাপড় প্রথমে নরসিংদীর বাবুরহাট, নারায়ণগঞ্জের গাউসিয়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে যায়। সেখান থেকে সারাদেশে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছায়। দেশে মাথাপিছু কাপড়ের চাহিদা ২৫ মিটার আর তার প্রায় পুরোটাই সরবরাহ করে ওসব কারখানা। শিল্পখাত এবং বাজার সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলমান লকডাউনে দেশীয় ফ্যাশন শিল্পে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। পর পর দুই বছর মহামারীর ধাক্কা সামলাতে গিয়ে দেশীয় ফ্যাশন শিল্পের পরিসর অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে। গত এক বছরে ফ্যাশন হাউজের অনেক ছোট আউটলেটই বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক উদ্যোক্তা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের কারিগর, কর্মচারীদেরকেও চাকরি ছাড়তে হয়েছে। গতবছরও পহেলা বৈশাখের বাজার যখন নতুন নতুন ডিজাইনের শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস ও কুর্তা দিয়ে সাজানো হয়েছিল তখনই লকডাউন আসে। তখন লোকসান ও ঋণের বোঝা হালকা করতে ফ্যাশন হাউজগুলোতে কর্মী ছাঁটাই চলে। এ বছর পহেলা বৈশাখ ও রোজার ঈদকে সামনে রেখে হাউজগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিলেও আরো বেশি তীব্রতায় মহামারীর আঘাত এসেছে। মহামারীর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশীয় ফ্যাশন শিল্প। এমন পরিস্থিতিতে ফ্যাশন শিল্পের কত উদ্যোক্তা সামনের দিকে টিকে থাকতে পারবে সেটা বলা মুশকিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইনে কিছু ঈদের পোশাক বিক্রি হচ্ছে। তবে অধিকাংশ ফ্যাশন হাউজেরই অনলাইনে বিক্রির প্রস্তুতি ছিল না। তাছাড়া আগে থেকে যেসব বড় প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট ক্রেতাগোষ্ঠী রয়েছে, তারাই অনলাইনে ভাল বিক্রি করতে পারছে। অন্যরা ফেসবুকে বিক্রির চেষ্টা করছে। কিন্তু এদেশের ক্রেতাদের বড় অংশই অনলাইনে পোশাক কিনতে ভরসা পায় না। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবাই অনুধাবন করতে পেরেছে ভবিষ্যতে ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে অনলাইনেও জোর দিতে হবে। করোনার কারণে ব্যবসার এমন করুণ পরিস্থিতির কথা কখনোই কল্পনা করা যায়নি।
সূত্র জানায়, দেশের নির্মাণ খাতের একটি অপরিহার্য সামগ্রী হচ্ছে রড। করোনা প্রাদুর্ভাবে ওই রডের বাজারও সঙ্কটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চাহিদা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় বহু প্রতিষ্ঠানই দুই শিফটের পরিবর্তে এক শিফট চালুর পরিকল্পনা করছে। কারণ পরিবেশক বা খুচরা পর্যায়ে দোকানপাট এক সপ্তাহের বেশি বন্ধ থাকলে কারখানাও বন্ধ রাখা ছাড়া বিকল্প নেই। বর্তমানে দেশের প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান বছরে ৬০ লাখ টনের মতো রড উৎপাদন করে। তারা স্থানীয় চাহিদার পুরোটাই পূরণ করে। পাশাপাশি রফতানিও হয়। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবকিছু বন্ধ থাকলে একদিকে যেমন রডের কাঁচামালের সঙ্কট হবে, অন্যদিকে বাজারে চাহিদা ও বিক্রি কমে যাবে। তাছাড়া স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দখলে আসবাবপত্রের বাজারও। আগে পাড়া-মহল্লায় দোকান থেকেই আসবাবপত্র বানানো হতো। নব্বইয়ের দশকে দেশে ব্র্যান্ড ফার্নিচারের যাত্রা শুরু হয়। ওসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আসবাবপত্র রফতানিও করে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে ওসব কারখানা বিপাকে পড়েছে। লকডাউনে শোরুম বন্ধ থাকায় নতুন কোন অর্ডার মিলছে না। যদিও পুরোনো অর্ডারের আসবাবপত্র বানাতে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের কারখানা এখনো অর্ধেক জনবলে চালু রয়েছে। কিন্তু ওসব কাজ শেষ হয়ে গেলে কারখানা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। একইভাবে তীব্র সমস্যায় পড়েছে পুরান ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাদুকা শিল্পপল্লীগুলো। ওসব পাদুকা শিল্পপল্লীতে সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষের চপ্পল ও জুতা তৈরি করা হয়। ছোট ওই শিল্প খাতে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে। ঈদের আগে নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য তৈরি জুতার রমরমা ব্যবসা থাকে কিন্তু এবার লকডাউনের কারণে তা হচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, গত বছর লকডাউনে দোকান মালিকদের ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার পুঁজি বিনষ্ট হয়েছে। একই সঙ্গে পবিত্র রমজান ও ঈদ উপলক্ষে ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগও নষ্ট হয়েছে। এ বছরও ক্ষুদ্র. অতিক্ষুদ্র পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পবিত্র রমজান ও ঈদ উপলক্ষে কিছুটা ব্যবসার আশায় প্রায় গত বছরের মতোই বিনিয়োগ করে। কিন্তু এবারও আকস্মিকভাবে লকডাউন ঘোষণা করায় ক্ষুদ্র পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী গত বছরের মতো পুঁজি হারানোর ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এমন অবস্থায় ওই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সীমিত পরিসরে ব্যবসা করার সুযোগ প্রদান না করলে তারা পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে।
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশীয় শিল্পের নাজুক অবস্থা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ঈদের আগের এই সময়ে পাইকারি বাজারগুলো জমজমাট থাকে। কারখানাগুলো চলে দিনরাত। কিন্তু করোনার কারণে এখন সবকিছু বন্ধ করে দেয়ায় হয়তো আগামী দু/তিন দিন কারখানা চালানো যাবে। তারপর উৎপাদিস পণ্য কোথায় বিক্রি করা হবে। তখন বাধ্য হয়েই কারখানা বন্ধ করতে হবে।