অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে সার্ভিস চার্জ আরোপে বিনিয়োগে বড় ক্ষতির আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

0
155

টাইমস ডেস্ক:
দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সম্প্রতি গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন পরিষেবার ওপর ৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ আরোপ করা হয়েছে। একই সাথে ইজারা নেয়া জমির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং রক্ষণাবেক্ষণ চার্জও চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও বেজার প্রসপেকটাস ও ওয়েবসাইটে বিনিয়োগকারীদের জন্য ভ্যাট ও সার্ভিস চার্জমুক্ত সেবা ও কর অবকাশ সুবিধাসহ নানা ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওসব প্রতিশ্রুতির পর সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়ায় শিল্প উদ্যোক্তারা বিস্মিত, হতভম্ব ও ক্ষুব্ধ। তাদের মতে, দেশে এমনিতেই বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে বিনিয়োগকারীদের আনা হয়েছে। এখন বেজার এমন সিদ্ধান্তে বিনিয়োগে বড় ধরনের ক্ষতি বয়ে আনবে। কারণ উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে। বেজা ও বেইজা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারা দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ টানতে শিল্প উদ্যোক্তাদের যেসব সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল বেজা এখন তা থেকে সরে যাচ্ছে। সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে জমির মূল্যের ওপর কোনো ধরনের ভ্যাট দিতে হবে না; গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো পরিষেবা গ্রহণে সার্ভিস চার্জ বা সেবা খরচ থাকবে না; ১০ বছরের কর অবকাশসহ নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক অঞ্চলে টেনে আনা হয়েছে। কিন্তু এখন বেজার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সেব সুযোগ-সুবিধা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অথচ বিনিয়োগকারীদের অন্ধকারে রেখে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই বেজা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মধ্যে ৩০টিরও বেশি অঞ্চলে উন্নয়নের কাজ চলছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হচ্ছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। সেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী বিনিয়োগ করেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারীদের হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি বেজা থেকে জারি করা সার্কুলার অনুযায়ী, সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প-কারখানায় পানির সংযোগ নেয়ার পর পানির বিল দেয়ার পাশাপাশি একজন বিনিয়োগকারীকে বাড়তি ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। একইভাবে গ্যাস সংযোগ নেয়ার পর গ্যাস বিল দেয়ার পাশাপাশি বাড়তি ৫ শতাংশ সেবা খরচ গুনতে হবে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও বাড়তি ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। তাছাড়া শিল্প-কারখানা থেকে তৈরি হওয়া ময়লা পানি পরিশোধন করতে চাইলে সেখানেও ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। আবার তরল বর্জ্য শোধন করতে চাইলে ব্যবসায়ীদের সেখানেও আলাদা করে ৫ শতাংশ সেবা খরচ দিতে হবে। তাছাড়া ব্যবসায়ীদের ইজারা নেয়া জমির মূল্যের ওপর ভ্যাট না থাকলেও এখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, ইজারা নেয়া জমির মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। তার সাথে ব্যবসায়ীদের জন্য থাকছে না টানা ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধাও। যে কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইজারা নেয়া প্রতি বর্গমিটার জমি বা অবকাঠামোর ওপর বার্ষিক ০.০৫ ডলার হারে রক্ষণাবেক্ষণ চার্জও দিতে হবে।
সূত্র আরো জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫০ বছরের জন্য ব্যবসায়ীরা জমি ইজারা নিয়েছে। জমির নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে সেখানে ভূমি উন্নয়ন করে এখন অবকাঠামো নির্মাণ করছে তারা। কিন্তু এখন এনবিআর বলছে ব্যবসায়ীদের জমির ইজারা মূল্যের ওপর নতুন করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। যার প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর। তাছাড়া সরকারের এমন সিদ্ধান্তে অর্থনৈতিক অঞ্চলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবে বলেও ব্যবসায়ীরা মনে করছে। সেজন্য জমির ইজারা মূল্যের ওপর থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে ব্যবসায়ীরা যে জমি ইজারা নিয়েছিল সেই ইজারার কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংকের ঋণ মিলছে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেয়া চিঠিতে বেজিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইজারানীতির প্রতিকূল শর্তের কারণে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে না। অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে ব্যবসায়ীদের যে প্রত্যাশা ও আস্থা ছিল ভ্যাট ইস্যুতে বেজার কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার পর পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। অথচ ব্যবসায়ীরা গভীর আগ্রহে শিল্প ইউনিট স্থাপনের পর থেকে কর অবকাশ সুবিধা উপভোগের অপেক্ষায় ছিলেন। অর্থনৈতিক অঞ্চলে যে কোনো পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেই তা পাওয়ার কথা ছিল। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও অনির্দিষ্ট সময়ের বিলম্ব করা হচ্ছে। বেজার প্রতিশ্রুত অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বন্দর সুবিধা দেয়ার কথা ছিল। অথচ বন্দর নির্মাণের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের (বেজিয়া) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান আশরাফুল হক চেšধুরী জানান, বেজা উদ্যোক্তাদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য টেনে এনেছে, সেসব প্রতিশ্রুতি তারা এখন আর রাখছে না। এনবিআরের মাধ্যমে নতুন নতুন এসআরও (আদেশ) জারি করে সার্ভিস চার্জ আরোপ করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা যখন বেজার কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়েছিল তখন গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন পরিষেবার ওপর অতিরিক্ত মাসুলের কথা চুক্তিতে ছিল না। এখন সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সরকার বেশি বিনিয়োগকারী আকর্ষণের যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এদেশের ব্যবসায়ীরা তাতে সমর্থন দিচ্ছে। এমনকি দেশের অর্থনীতিকে সরকার যে উ”চতায় নিয়ে যেতে চায়; তাতেও ব্যবসায়ীদের সহায়তা রয়েছে। সরকারের উচিত ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের সমর্থন দেয়া এবং বিদ্যমান সমস্যা ও বাধাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানীয় ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকেই নিরুৎসাহিত করবে। কারণ প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিনিয়োগ আকর্ষণে ওসব দেশের সরকার অনেক লোভনীয় সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। তারা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ টানতে পরিষেবায় সার্ভিস চার্জ অব্যাহতি দিচ্ছে। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, উরুগুয়ে, কুয়েত, তাইওয়ান ও ফিলিপাইন সবাই তাদের বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেছে যে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ওপর যে বিল আসবে তা কমানো হবে। এদেশ যদি প্রতিবেশীদের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ টানতে চায় তাহলে তাদের তুলনায় বেশি প্রণোদনা দিতে হবে।
অন্যদিকে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জানান, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির মতো পরিষেবায় ৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জের সিদ্ধান্তটি নতুন করে চাপিয়ে দেয়া নয়। চার বছর আগেই গভর্নিং বোর্ডের সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তাছাড়া আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (বেপজা) বিনিয়োগকারীদের প্রতিটি পরিষেবার জন্য ১০ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। বেজা তো ১০ শতাংশ আরোপ করেনি, মাত্র ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আরোপ করেছে। তাছাড়া বেজা বিনিয়োগকারীদের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তাঘাট, সেতু, জমি উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ বিভিন্ন পরিষেবার সংযোগ দিচ্ছে। তা বলে ব্যবসায়ীদের সব কিছু ফ্রি দেয়া হবে? বেজা তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করছে। ব্যবসায়ীদের জন্য এত টাকা খরচ করছে বেজা, তাই বলে তারা কিছু সার্ভিস চার্জ দিতে পারবে না? যদি সার্ভিস চার্জ না দেয় তাহলে বেজা চলবে কিভাবে? বেজার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হবে কিভাবে?