কারসাজি বন্ধে কোরবানীর পশুর চামড়া সংরক্ষণে সরকারি গুদাম তৈরির উদ্যোগ

0
171

খুলনাটাইমস এক্সক্লুসিভ: কোরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে প্রতি বছরই ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে আসছে। এবার তা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চামড়ার ন্যায্য দাম নিশ্চিতে সরকার জরুরিভাবে কমিউনিটি পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণ নামে স্থায়ী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তার মাধ্যমে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সরকারি গুদামে চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। সেখানে লবণ দিয়ে গুদামে চামড়া সংরক্ষণ করে ব্যবসায়ীদের কাছে তা তিন মাস ধরে বিক্রি করা হবে। তারপরও ভাল দাম না পাওয়া গেলে ওসব লবণ দেয়া চামড়া বিদেশে রফতানি করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কোরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের ছিনিমিনি খেলা আগামী বছর থেকেই বন্ধ হবে। ফলে প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের আর চামড়া ফেলে দিয়ে মূল্যবান জাতীয় সম্পদ নষ্ট করতে হবে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কমিউনিটি পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণ প্রকল্পে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ, সঠিক পদ্ধতি মেনে পশু থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেয়া, নিয়ম মেনে লবণ দেয়া, দ্রুত অপসারণ এবং স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে চামড়া সংরক্ষণ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একজন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ দিতে যাচ্ছে। আগামী কোরবানির আগেই সারাদেশে এই প্রকল্পের আওতায় জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও সরকারি গুদামে কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ করা হবে। তাছাড়া শহরগুলোতে ওয়ার্ড পর্যায়ে ওসব গুদামের ব্যবস্থা করা হবে। তাতে করে কোরবানির দিন ট্যানারি কিংবা আড়তে চামড়া বেচাকেনার আর কোন তাড়াহুড়া থাকবে না। ৩ মাস লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করা গেলে পরবর্তী সময়ে ভাল দামে ট্যানারি মালিক, আড়তদার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা সম্ভব হবে। আর ওসব জায়গায় ভাল দাম না পেলে যে কোন উদ্যোক্তা সরকারি অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশে লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া রফতানি করতে পারবে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ের মৌসুমি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোর পক্ষে সংগৃহীত কোরবানির চামড়া ৩ মাস পর্যন্ত লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। ওই লক্ষ্যে প্রকল্পের আওতায় সরকারি উদ্যোগে জেলা, উপজেলা ও কোন কোন ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পর্যায়ে গুদাম ও ছাউনি নির্মাণ করে দেয়া হবে। তাতে সহজেই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লবণযুক্ত চামড়া মজুদ ও সংরক্ষণ করতে পারবে। পরবর্তীতে সুবিধাজনক সময়ে চামড়া দর কষাকষির মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করতে পারবে। ফলে দেশের সর্বত্র কোরবানির চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত হবে। তাতে চামড়া নিয়ে যে কোন নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে।
সূত্র জানায়, চামড়া শিল্প বিকাশে বেশ কয়েকটি নীতিমালা এবং সাভারের হেমায়েতপুরে শিল্পনগরী গড়ে তোলা হলেও কোরবানির চামড়া নিয়ে অরাজকতা বন্ধ হয়নি। অথচ চামড়া শিল্পখাত দেশের রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে । ট্যানারিতে উৎপাদিত ক্রশড ও ফিনিশড লেদারের পাশাপাশি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ চামড়াজাত পণ্যের রফতানিও বিদেশে বাড়ছে। তাছাড়া দেশেও চামড়ার বিপুল চাহিদা রয়েছে। চামড়াজাত পণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। তারপরও দেশের মানুষ চামড়ার তৈরি জুতা, বেল্ট, ব্যাগ, পার্স ও জ্যাকেট ব্যবহার করছে। দেশে অসংখ্য চামড়ারজাত পণ্যের শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। এ কারণে দেশের অর্থনীতি, শিল্প, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে এই শিল্পখাতের অবদান অনেক। সরাসরি চামড়া শিল্পখাতে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর ওই ৫ লাখ মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৫ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত। কিন্তু দেশে কোরবানি এলেই কমদ ামে চামড়া কেনার একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে। গত দু’বছর ধরে পানির দামে কোরবানির চামড়া বিক্রি হচ্ছে। চামড়া বেচতে না পেরে রাগে-ক্ষোভে দেশের সাধারণ মানুষ কোরবানির চামড়া নদী, সাগর ও রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। তাতে করে চামড়া শিল্প খাত চরম সঙ্কটে পড়ছে। এ অবস্থায় সরকারি এ উদ্যোগকে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, চামড়া শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল। এটি ফ্রি বা বিনামূল্যে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। ন্যায্য ও সঠিকদাম নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া ব্যবসায়ীদের মতে, এভাবে একটি শিল্পখাত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে না। কোরবানি এলে এই খাতে করুণদশা তৈরি হয়। সমস্যা কোথায়, কেন এমন হচ্ছে এর একটি গভীর অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন। এ শিল্পখাত বাঁচাতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
সূত্র আরো জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কমিউনিটি পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণ প্রকল্পটিকে জরুরি হিসেবে গ্রহণ করছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের অপ্রত্যাশিত খাত থেকে এ প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ফিজিবিলিটি স্টাডিসহ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরবর্তী পর্যায়ে নিজস্ব অর্থায়নের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছে অর্থ সহায়তা চাওয়া হতে পারে। তবে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে কি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে তা এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত মূল্যে ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের কাছ থেকে চামড়া কিনবে। ইতিমধ্যে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ না দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এ বছর পবিত্র ঈদ-উল-আজহার জন্য নির্ধারিত দর গত বছরের চেয়ে কম নির্ধারণ করা হয়। এ বছর ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা গত বছর ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর খাসির চামড়া সারা দেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত বছর খাসির চামড়া ১ থেকে ২০ টাকা ও বকরির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
অন্যদিকে সাভারের ট্যানারিগুলো থেকে ক্রাশড ও ফিনিশড লেদার কিনে নিয়ে দেশের শতাধিক প্রতিষ্ঠান চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য তৈরি করছে। প্রতিবছরই বাড়ছে চামড়ার চাহিদা। দেশে ও বিদেশে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে চামড়ার তৈরি জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ও পার্সসহ বিভিন্ন সামগ্রী। ওসব সামগ্রী বিদেশে রফতানি করে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। দেশে বাজার তৈরির পাশাপাশি রফতানিতে এ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, বে ইম্পোরিয়াম, পিকার্ড বাংলাদেশ, জেনি সুজ, এবিসি ফুটওয়্যার, রাইডার লেদার ব্যাগস এ্যান্ড লাগেজ, ইয়োকো লেদার এবং ঢাকা লেদার কর্পোরেশন অন্যতম উদাহরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের তৈরি জুতা, ব্যাগ, পার্স ও বেল্ট ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হচ্ছে। বর্তমানে চামড়া শিল্পখাতে ৬০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের সুযোগ রয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ এ শিল্প খাতে ৪৩ হাজার কোটি টাকার রফতানির লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২২০ বিলিয়ন ডলারের বাজার থাকলেও বাংলাদেশ এ খাতে মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করে থাকে। কিন্তু এ খাত উন্নয়নে যে রোডম্যাপ দেয়া হয়েছে ওই অনুযায়ী কাজ চলছে। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পখাত হতে পারে চামড়া শিল্পখাত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানারি এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহিন আহমেদ জানিয়েছেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যে ট্যানারিগুলো চামড়া কিনতে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। লবণযুক্ত চামড়া নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হবে, এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।
একই প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন জানান, চামড়া জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করতে হবে। কোরবানির সময় সারাবছরের অর্ধেক চামড়া সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে সঠিক দাম নিশ্চিত হয় না। চামড়া নষ্ট হওয়ার খবর আসে। এমন সমস্যা সমাধানে একটি স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। কমিউনিটি পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলায় এবার কমিউনিটি পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণ ও মজুদ করা হয়েছে। ওই এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এখন সরকার নির্ধারিত দামে ট্যানারি ও আড়তে চামড়া বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে। অথচ কোরবানির দিন যারা তাড়াহুড়া করে চামড়া বিক্রি করে দিয়েছে তারা ভাল দাম পায়নি। এ কারণে কমিউনিটি পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণ করা গেলে এই পণ্যটি নিয়ে এতো ঝামেলা তৈরি হবে না। তাতে চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি এই শিল্পখাতের বিকাশ হবে।