রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমার-ভারতের আলোচনা, আশাবাদী নয় বাংলাদেশ

0
164

টাইমস ডেস্ক:
ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান এম এম নারাভানে ও পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রীংলার ৪-৫ অক্টোবর মিয়ানমার সফরের সময়ে রোহিঙ্গা বিষয়টি আলোচনায় আসাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও খুব বেশি আশাবাদীদ নয় বাংলাদেশ। ঢাকা, দিল্লি ও ইয়াঙ্গুনের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা এ বিষয়ে আলোচনা করলেও ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও আভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে চাপ প্রয়োগের কোনও আগ্রহ নেই তাদের। ভারতের কর্মকর্তারা সফরের সময়ে মিয়ানমারের সিনিয়র জেনারেল মিং আং হ্লাইং, স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচিসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বিষয়ে একটি সূত্র জানায়, দুইপক্ষের মধ্যে বাস্তুচ্যুত মানুষদের বিষয়টি আলোচনা হয়েছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনও কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তিনি বলেন, ভারতের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যেভাবে রোহিঙ্গা বিষয়টি এসেছে সেটি দেখে মনে হয় অন্য আরও ১০টি সাধারণ ইস্যুর মতো এটি আলোচিত হয়েছে। আরেকটি সূত্র জানায়, মিয়ানমারে বিভিন্ন খাতে ও প্রকল্পে ভারতের অনেক স্বার্থ জড়িত আছে। ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন বিষয় নিয়ে মন কষাকষি করবে না দিল্লি। এছাড়া ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কিছুটা সংখ্যালঘু বিরোধী এবং সে কারণে মুসলিম রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত চাপ দেবে এমন মনে হয় না বলে তিনি জানান। প্রসঙ্গত, ভারতীয় কর্মকর্তাদের সফর শেষে ভারত থেকে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় সেখানে বলা হয় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উভয় দেশ একে অপরকে গুরুত্ব দেয় এবং এই সফর তার প্রতিফলন।
মিয়ানমারকে যা বলেছে ভারত: বাংলাদেশের অনুরোধের পটভূমিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধান তাদের সদ্যসমাপ্ত মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে সে দেশের নেতৃত্বকে সরাসরি আহ্বান জানিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। নভেম্বরে মিয়ানমারে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের আগেই অন্তত কিছু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়া হোক বলেও ভারত বৈঠকে প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ও সেনাপ্রধান জেনারেল এম এম নারাভানে একসঙ্গে এক বিরল সফরে গত রোববার মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিদো গিয়েছিলেন, দুদিনের সফর শেষে তারা সোমবার রাতে দিল্লিতে ফিরে এসেছেন। মিয়ানমারের নেত্রী তথা স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এবং সে দেশের সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ অং মিন লেইং-র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয়ে তাদের বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তবে সেই সব বৈঠকের এজেন্ডায় এমন একটি বিষয়ও ছিল, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থও যুক্ত। আর সেটি হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন। বস্তুত গত সপ্তাহেই বাংলাদেশ-ভারত জেসিসি বৈঠকেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে মোমেন দিল্লিকে অনুরোধ করেছিলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে রাজি করাতে ভারত যেন তাদের ‘প্রভাব খাটায়’। শ্রিংলা ও জেনারেল নারাভানের মিয়ানমার সফরে বাংলাদেশের সেই অনুরোধেরও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সফরের শেষে ভারতের পক্ষ থেকে যে প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে : রাখাইন স্টেট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (আরএসডিপি) অধীনে যে উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে, উভয় পক্ষই (ভারত ও মিয়ানমার) তা নোট করেছে এবং একটি স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার গড়ে তোলাসহ কর্মসূচির তৃতীয় পর্যায়ে কী কী প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে, তা আলোচিত হয়েছে। রাখাইনে কৃষি পদ্ধতির আধুনিকীকরণে একটি প্রকল্প হাতে নিতে সমঝোতাও স্বাক্ষরিত হয়েছে। রাখাইন থেকে আশ্রয়চ্যুত মানুষজনের নিরাপদ, টেকসই ও দ্রুত প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারতের সমর্থনও ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্র সচিব। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ভারত যে চায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া হোক, সেই অবস্থান মিয়ানমারের কাছে এই সফরে খুবই পরিষ্কার করে তুলে ধরা হয়েছে। সাউথ ব্লকের এক শীর্ষ কর্মকর্তার কথায়, প্রেস বিবৃতির বক্তব্য খুঁটিয়ে পড়লে বা বিটুইন-দ্য-লাইনস দেখলেই সেটা আশা করি পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে ভারত মিয়ানমারকে ঠিক কী প্রস্তাব দিয়েছে? নির্ভরযোগ্য সূত্রে যা জানা গেছে তা হলো- পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা বলেছেন, রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গারা ফিরে এসে যাতে ভালোভাবে থাকতে পারে, সেজন্য বিপুল অর্থ খরচ করে ভারত বেশ কয়েকশ আবাসন ইউনিট ও অনেক স্কুল পর্যন্ত বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেইসব বাড়িতে কেউ থাকছে না, স্কুলেও বাচ্চারা যাচ্ছে না। ভারতের এই উদ্যোগের মর্যাদা দিতে মিয়ানমারের উচিত হবে পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের সেখানে ফিরতে সাহায্য করা। দ্বিতীয়ত, ভারত চাইবে, প্রথম পর্যায়ে যে রোহিঙ্গাদের ফেরানো হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারত – দুদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গারাই থাকবেন। এই ‘প্রথম ব্যাচে’র রোহিঙ্গাদের নিজেদের গ্রামে ফেরানোর জন্য রাজি করাতে ভারত সক্রিয় ভূমিকা নেবে। দরকারে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য করবে বলেও কথা দেওয়া হয়েছে। (বাংলাদেশে এই মুহূর্তে প্রায় ১০-১২ লাখ ও ভারতে প্রায় ৫০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা আছে। কিন্তু ‘প্রথম ব্যাচে’ যারা যাবেন, তার মধ্যে এই আনুপাতিক হার রক্ষা করা সম্ভব কিনা, সেটা অবশ্যই এখনও স্পষ্ট নয়) । তৃতীয়ত, ঠিক এক মাসের মাথায় (৮ নভেম্বর) মিয়ানমারে পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনের আগে খুব শিগগিরই প্রথম ব্যাচের রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া হলে তা আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও খুব ইতিবাচক একটা বার্তা দেবে বলে ভারত মনে করছে। মিয়ানমার নেতৃত্বকেও এই মনোভাবের কথা জানানো হয়েছে। তবে এত তাড়াতাড়ি প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে তারা কিছুটা সংশয়ও প্রকাশ করেছেন। মিয়ানমারের নেতৃত্বের অনুভূতির প্রতি মর্যাদা দিয়ে বৈঠকে রোহিঙ্গা শব্দটি ভারতের পক্ষ থেকে একেবারেই ব্যবহার করা হয়নি, তার বদলে যথারীতি বলা হয়েছে ‘রাখাইন থেকে আশ্রয়চ্যুত মানুষজন’। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এইসব প্রস্তাবের ব্যাপারে মিস সু চি বা সে দেশের সামরিক নেতৃত্বের মনোভাব দিল্লির কাছে ‘ইতিবাচক’ই ঠেকেছে। তবে প্রস্তাবিত প্রত্যাবাসনের ‘লজিস্টিকস’ চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে এখনও বিস্তর আলোচনা বাকি আছে। পাশাপাশি, শ্রিংলা ও জেনারেল নারাভানে তাদের সফরে বিষয়টি যেরকম জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন, তা প্রতিবেশী বাংলাদেশকেও একটা খুব সদর্থক বার্তা দেবে বলে সাউথ ব্লক আশা করছে।