আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ জাবি

0
368

খুলনাটাইমস: উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৪টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুপুরে সিন্ডিকেটের জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। আন্দোলনকারীরা বলছেন, গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থানরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ওই হামলায় আট শিক্ষকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। সেখানে দায়িত্ব পালন করার সময় চার সাংবাদিকও ছাত্রলীগ কর্মীদের মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগ বলেছে, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ‘শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ’ ছিল বলেই তাদের এ তৎপরতা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেছেন, ঘটনাস্থলে মব তৈরি হয়েছিল। চেষ্টা করেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বড় ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর আছি। আহতদের মধ্যে আটজনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. রেজওয়ানুর রহমান জানিয়েছেন। উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে গত সোমবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করেছে রেখেছিলেন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১১টায় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক-কর্মকর্তারা উপাচার্যকে বাসা থেকে বের করে তার কার্যালয়ে নিয়ে যেতে আসেন। এসময় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক-বিত-া চলতে থাকে। এর মধ্যেই বেলা পৌনে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানার নেতৃত্বে একটি মিছিল ঘটনাস্থলে আসে এবং আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়। ছাত্রলীগ কর্মীরা আন্দোলনকারীদের এলোপাতাড়ি মারধর করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় একাধিক শিক্ষককেও চ্যাংদোলা করে দূরে নিয়ে ফেলতে দেখা যায় ছাত্রলীগ কর্মীদের। নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা রয়েছেন আহত শিক্ষকদের মধ্যে। আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে- ৪৪ তম আবর্তনের দর্শন বিভাগের মারুফ মোজাম্মেল, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাহাথির মুহাম্মদ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাইমুম ইসলাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের রাকিবুল ইসলাম রনি, ৪৮ তম আবর্তনের ইংরেজি বিভাগের আলিফ মাহমুদ, অর্থনীতি বিভাগের উল্লাস, দর্শন বিভাগের রুদ্রনীল, প্রতœতত্ত্ব বিভাগের সৌমিক বাগচীর নাম জানা গেছে। এ ছাড়া ৪৪তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্রী ছন্দা ও ৪৭ তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাউদা নামের দুই নারী শিক্ষার্থীকেও মারধরের শিকার হতে হয়েছে। প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাইদুল ইসলাম, বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি আজাদ, বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু, বাংলা লাইভ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল সংবাদ সংগ্রহের সময় হামলার শিকার হন। মারধরের সময় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক সোহেল আহমেদ, নাসির উদ্দিন, আতিকুর রহমান, আবদুল মান্নান চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান জনি সহ কয়েকজনকে ‘ধর ধর’, ‘জবাই কর’ ও ‘মার মার’ বলে চিৎকার করতে দেখা যায়। হামলা চলাকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ছিল নীরব। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে কোনো মন্তব্যও তারা করেননি। আন্দোলনে থাকা শিক্ষক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এরকম ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি। উপাচার্যপন্থি শিক্ষকদের উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ উসকানিতে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ছাত্রলীগ যখন আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে তখন ভিসিপন্থি শিক্ষকরা তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে হাততালি দিয়েছে। হামলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, আমরা শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। অন্যদিকে আন্দোলকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, আন্দোলনে কোনো শিবির সংশ্লিষ্টতা নেই। যে কোনো শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শিবির ব্লেইম দেওয়াটা পুরোনো অপকৌশল। বুয়েটের আবরারকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে, এখানেও একইভাবে অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছে। উপাচার্য অপসারণ আন্দোলনের সাথে যুক্ত এমন অনেকেই ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছে, যারা ক্যাম্পাসে বামপন্থি রাজনীতির পরিচিত মুখ। তাই এসব কথা তাদের দুর্নীতি ঢাকার অপকৌশল। মারধরের ঘটনার আধা ঘণ্টা পরে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তার সমর্থক শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে নিজের কার্যালয়ে যান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের সামনে সহকর্মী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের ‘গণঅভ্যুত্থানের ’ জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী যখন এক সাথে দাঁড়ায়, তখন শিক্ষার্থী শিক্ষার্থীকে না ঠেকালে আমরা যেতে পারতাম না। যা হওয়ার হয়েছে, এটাকে আপনারা হামলা বলতে পারেন, কিন্তু আমি বলব না। শুধু ‘শারীরিক ধাক্কাধাক্কিকে’ হামলা বলা যায় কি না- সেই প্রশ্ন করে উপাচার্য বলেন, ওরা আহত হয়েছে শারিরিকভাবে- আপনারা বলতে পারেন। আমাদের মেয়েদেরকেও তারা ধাক্কা দিয়েছে, শিক্ষক মেয়েদেরকে। আমি এবং ট্রেজারার, আমরা মর্মাহত, তারা আমাদের যে ভাষায় গালাগালি করেছে। আন্দোলনের পেছনে জামায়াতপন্থিদের হাত রয়েছে মন্তব্য করে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, তদন্ত শুধু আমি করব না। সরকারের উচিত হবে এই চক্রটাকে দেখা। এরা কোথায় ছড়িয়ে আছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অবস্থা কেন খারাপ হচ্ছে। এদিকে, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আবার আন্দোলন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হবে কেন- এ প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন রেজিস্ট্রার ভবন থেকে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল বের করে।