খুলনা রেলের তেল চুরির ঘটনার নেপথ্যে উর্ধতন কর্তারা : চলছে উৎকোচ বানিজ্য

0
831

ফকির শহিদুল ইসলামঃ
খুলনা রেল স্টেশনে তেল পাচারকারী মামলার আসামীরা প্রকাশ্যে স্টেশন ইয়ার্ডে ডিউটি করছেন । রেলওয়ে পুলিশ তাদের দেখেও না দেখার ভান ধরছেন। তেলচুরির ঘটনার কয়েকদিন গাঁ ঢাকা দিয়ে থাকলেও সংশ্লিষ্ঠ বিভাগের উর্ধতন কর্তাদের মোটা অংকের অর্থ বানিজ্যেই তারা কাজে যোগদান করছে ।
খুলনার বহুল আলোচিত রেলের তেল চুরির ঘটনায় গঠিত বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দখিল করা হয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর তদন্ত কমিটির আহবায়ক মো: নাছির উদ্দিন এ তদন্ত প্রতিবেদন পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক পাকশী মজিবর রহমান এর দপ্তরে দাখিল করেন। গত ১৮ অক্টোবর রাতে সরকারি তেল চুরির ঘটনায় তদন্ত কমিটিকে তিন কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় নির্ধারিত থাকলেও কমিটি গঠনের ২৭দিন পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনে রেলের আরএনবি (নিরাপত্তা) তে নিয়োজিত তেল চুরির মামলার এজহারভুক্ত আসামী শ্রমিক নেতা জাহাঙ্গীর, মাহামুদ ওরফে ট্যারা মাহামুদ, মোঃ শরীফুল ইসলাম, মোঃ মহিউদ্দিন এবং ঘটনার দিন ঐ স্থানে ডিউটিরত নিরাপত্তা সদস্য মাসুদ ইলেকট্রিক বিভাগের বিএম সেলিম , খায়রুল বাশার এই তেল চুরির ঘটনায় সরাসরি এজাহার ভুক্ত আসামী ছাড়াও বাহিরের কতিপয় ব্যাক্তিদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে তদন্ত কমিটির আহব্য়ক মো: নাছির উদ্দিন জানান। তিনি তদন্ত প্রতিবেদনে তেল পাচারের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের সুপারিশ করেন । তেল পাচারের সাথে জরিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহনের বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক মোঃ মজিবুর রহমান এর কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বলেন, স্ব স্ব ডিপার্টমেন্টের প্রধানদের জানানো হয়েছে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য। তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার দশদিন পার হলেও এখনো তেল চুরির ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে কোন বিভাগই শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা না করায় প্রকাশ্যে রয়েছে এবং তারা স্ব স্ব জায়গায় কাজ করছেন কিভাবে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত কন্ঠে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, এ চুরির সাথে আমার ডিপার্টমেন্ট নয় সাংবাদিকরাও জড়িত। এবং তথ্য নিতে হলে আপনাকে পাকশী আসতে হবে। ফোনে কোন তথ্য তথ্য দেওয়া যাবে না। এ সময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তেল চুরির সাথে জড়িতরা রেলের উর্ধতন কর্মকর্তাদের মোটা অংকের উৎকোচ দিয়ে তারা বহাল রয়েছেন। তিনি স্বীকার করেন ম্যানেজ না করলে কি তারা ডিউটি করতে পারে। তেল পাচারকারীরা ঘটনার কয়েকদিন গাঁ ঢাকা দিয়ে থাকলেও এখন তারা খুলনা রেল ষ্টেশনে বীরদর্পে ডিউটি করছেন । নিজের অপরাধ ধামাচাপা দিতে তাদের কাজে যোগদানে প্রতক্ষ সহায়তা করেন (আর,এন,বি,)র সি,আই রফিকুল ইসলাম । এ ছাড়াও রেলের বড় ধরনের তেল চুরির সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে কাশিপুর,৪নং ঘাট ও জংশন এলাকায় । এই সিন্ডিকেটে রয়েছে আর,এন,বি,ইয়ার্ড মাষ্টার,লোকশেড,তেলের ট্যাংকার মাষ্টারসহ উত্তরবঙ্গের প্রায় ২৫টি পাওয়ার প্লান্টের জ্বালানী বিভাগে দায়িত্বরতরা চোরাই তেল পাচার সিন্ডিকেটে জরিত রয়েছে ।
খুলনা রেলওয়ের চুরির ঘটনায় গঠিত বিভাগীয় তদন্ত কমিটির আহবায়ক মো: নাছির উদ্দিনের কাছে তদন্তের তিন কার্যদিবস পার হওয়ায় প্রথম সক্ষাতকাওে তিনি তদন্ত বিলম্বের কারন হিসেবে বলেছেন,

আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম এই তেল চুরির ঘটনায় শুধুমাত্র ডিপার্টমেন্ট-এর লোকজন রয়েছে। তবে সরেজমিন তদন্তে গিয়ে জানা যায়, সরকারি তেল পাচারে একটি শক্তিশালী চক্র আছে। যার সাথে ডিপার্টমেন্ট এর বাইরেরও প্রভাবশালী লোকজন জরিত আছে।
তেল চুরির ঘটনায় র‌্যাব-এর পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও থানা )র কর্মকর্তা মোঃ আনিছুর রহমান বাদী হয়ে খুলনা জিআরপি থানার একটি মামলা দায়ের করেন । যার মামলা নং-২ ধারা ৩৭৮,৪১১,১০৯ এই তিনটি ধারায় গত ১৯-১০-২০১৮ ইং তারিখে মামলটি রুজু করেন । মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা জিআরপি থানার এস আই মফিজুল হক । মামলা দায়েরের একমাস পার হলেও অজ্ঞাত কারনে এজাহার নামীয় কোন আসামীকে তিনি গ্রেফতার করেননি । মামলার আসামীরা প্রকাশ্যে দিবালোকে স্টেশনে ডিউটি করছে অথচ তাদের গ্রেফতারে কোন তৎপরতা নেই জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা এ প্রতিবেদকে জানান আসামীরা সরকারী কর্মচারী বিধায় তাদের গ্রেফতারে সংশ্লিষ্ঠ উর্ধতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয় । ফৌজদারী মামলায় কোন আসামী ধরতে অনুমতির কি প্রয়োজন হয় জানতে চাইলে তিনি এরিয়ে যান । একমাস ৬দিনেও তেল চুরির মামলায় জরিতদের আটকের অনুমতি পাননি বা সংশ্লিষ্ঠ বিভাগে অনুমতির কোন আবেদন করছেন কিনা তা জানাতে তিনি পারেনি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ।

প্রসঙ্গত: গত ১৮ অক্টোবর রাতে সরকারি তেল চুরির স্থানে র‌্যাব-৬ অভিযান চালায়। পরদিন ১৯ অক্টোবর রাতে খুলনা জিআরপি থানায় মামলা হয়। পাশাশি পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক ঘটনা তদন্তে চার সদস্য বিশিষ্ট বিভাগীয় কমিটি করা হয় । গঠিত কমিটি গত (২৩ অক্টোবর) খুলনা ষ্টেশন এলাকা পরিদর্শন করে।
এদিকে সবথেকে বড় তেল চুরির কারবার চলে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ডিপো হতে আনা খুলনা থেকে পার্বত্যীপুর,নাটোর,হরিয়ান তেল ডিপো এবং উত্তর বঙ্গের প্রায় ২৫টি বিদ্যুৎ প্লান্টে তেল পরিবহণ করা হয় ওয়াগান(এমটি)র মাধ্যমে । আর এই বিপুল পরিমান জ্বালানী তেল পরিবহনের ওয়াগান লোড করে তেল ডিপো থেকে এনে যারা জংশনে বুঝিয়ে দেয়, তারাই এই পাচারের সাথে জড়িত। আর জংশনে আসা তেল ভর্তি ওয়াগানকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিশাল চুরির সিন্ডিকেট। এখানে ডিপো থেকে করা সীলগালা খুলে তেল বের করে পুনরায় হুবহু ডিপোর সীলগালা করা হয়। এরা সব পক্ষকে ম্যানেজ করে চোরাই কারবার অব্যাহত রেখেছে। সূত্র বলছে, অবৈধ চোরাই তেলের কারবার হয় মুলত তিনটি পয়েন্টে। এগুলো হচ্ছে খুলনা রেলওয়ের স্টেশন, জংশন, কাশিপুর তেল ডিপো,৪ ও ৫ নং ঘাট এলাকায়।
সূত্র বলছে, ওয়াগান (এমটি)র তেল চুরি কার্যক্রমের সাথে জড়িত রেলওয়ের আরএনবি-নিরাপত্তা বাহিনীর (গোয়েন্দা) সদস্য বাদল সরদার, শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও সোহেল। তেল চুরিতে এদের সহযোগী করে থাকে আরএনবি-নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মানিক হোসেন, ওয়াছকরোনী, মাসুদ খাঁন ও শামীম,ইয়ার্ড মাষ্টার কুদরত,উজ্জল ও আঃ বারেকসহ কয়েকজন রেলকর্মী ।
সূত্র আরও দাবি করেছে, চোরাই তেল হতে অবৈধভাবে আসা সকল অর্থ জমা হয়(আর,এনবি) রেল নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাশিয়ারের কাছে। শুধু চোরাই তেল বাবদ অর্থই নয়, ষ্টেশন এলাকার (ট্রাক পার্কিং, দোকান ও হকার) দৈনিক কালেকশনও ক্যাশিয়ার লোক মারফত আদায় করেন। তিনিই স্ব স্ব বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তেল চুরির ও অন্যান্য অর্থ বুঝিয়ে দেন।

জানা গেছে, সরকারি তেল চুরি ঠেকানোর জন্য ঝটিকা অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব রেলওয়ে নিরাপত্তা বিভাগের। একইসাথে নিরাপত্তায় নিয়োজিত গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব অপকর্ম রোধে উর্দ্ধতনদের অবহিতপূর্বক ব্যবস্থার তাগিদ দেয়া। তবে চোরাই চক্রের সাথে যোগসাজস করে চলায় এটি রোধ হচ্ছে না। আর রেলওয়ে পুলিশের দায়িত্ব না-কি ট্রেন লাইনের ১০ গজের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এমন কথা তারা জানিয়েছে। যদিও সরেজমিনে দেখা গেছে রেল পুলিশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অবৈধ মালামাল আনা হয়। এজন্য নিয়মিত মাসোয়ারা আসে, সূত্র জানায়।

আরও জানা গেছে, সিবিএ নেতাদের ক্ষমতার পালাবদল হলেও কখনও থামেনি সরকারি তেল পাচার কার্যক্রম। চোরাই তেল বিক্রির অর্থের অংশ বিতরন হয় লোকোশেড ,লোকো বিভাগের শেডম্যান/এটেনডি, ডিউটি রোষ্টার, ইলেকট্রিক বিভাগের মিস্ত্রি, খালাসী, জিআরপি-রেলওয়ে পুলিশ, আরএনবি, আরএনবি-গোয়েন্দা, খুলনা ষ্টেশন এলাকায় নৌ পুলিশ পায়। এই চক্রে আরও আছে, মামলার এজাহার নামীয় আসামী জাহাঙ্গীর, মাহামুদ ওরফে ট্যারা মাহামুদ, মোঃ শরীফুল ইসলাম, মোঃ মহিউদ্দিনসহ ১০/১২ জন রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে তেল ক্রয় করে স্থানীয় তিথি এন্টার প্রাইজের মালিক শেখ আশরাফ আলী।

মামলার এজাহারে উলে­খ, রেলষ্টেশনের ষ্টেশন মাষ্টার ও এ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (ফোরম্যান)’দের সহায়তায় আর্থিকভাবে লাভবান হতেই আসামীরা একেঅপরের সহায়তায় বেআইনি পন্থায় এই অবৈধ কাজে লিপ্ত রয়েছে।

রেলওয়ে বিভাগ সূত্রমতে, সারাদেশে প্রতিদিন সাড়ে তিনশ’ ট্রেন চলাচল করে। এসব ট্রেনে দিনে গড়ে প্রায় পৌনে দুই লাখ লিটার ডিজেল খরচ হয়। এ হিসাবে বছরে ব্যয় হয় ছয় কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার লিটার। কোনো কোনো বছর এর চেয়ে কম-বেশিও হয়। এই ব্যবহূত তেল থেকে বছরে চুরি হয়ে থাকে প্রায় দেড় কোটি লিটার; যার বাজারমূল্য ৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। গড়ে প্রতিদিন চুরির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার লিটার। এর মধ্যে শুধু ইঞ্জিন ও পাওয়ারকার থেকে দিনে ২০ হাজার লিটার, ১১টি লোকোশেড থেকে প্রায় ১৫ হাজার লিটার এবং চলন্ত ট্রেন থেকে পাঁচ হাজার লিটার তেল চুরির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বছরে প্রায় এক কোটি টাকার ইঞ্জিন অয়েলও চুরি হয়। তেলের বাজারমূল্যের ওপরই চুরির অর্থ নির্ধারণ হয় এবং এর ভিত্তিতে তা ভাগবাটোয়ারা হয়।