কয়রায় আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ে শিক্ষার হার বেড়েছে, রয়েছে বেকার, নেই সুযোগ সুবিধা

0
353

ওবায়দুল কবির সম্রাট,কয়রা থেকে: কয়েক বছর আগেও আমাদের মধ্যে শিক্ষিত লোক ছিল না, এখন অনেকেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত। তবে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখেও চাকরী পাচ্ছে না। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ভাইভা প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়ে অনেকেই এখন বেকার জীবন কাটাচ্ছে। মুন্ডা (আদিবাসি) বলেই আমাদের সুযোগ-সুবিধা কম। সুবিধা, অসুবিধা আর সংকটময় জীবনের এমন কথাগুলো বলছিলেন কয়রা উপজেলার ৬নং কয়রা গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি (আদিবাসী) পরিবারের সত্তর বছর বয়সী তারাপদ মুন্ডা। বয়সের ভারে ন্যুজ এ বৃদ্ধ এখন কালের সাক্ষী। গল্পে গল্পে বলে দিলেন ছেলেবেলা থেকে শুরকরে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত নানা অভিজ্ঞতার কথা। শেষ বয়সেও শরীরের অটুট বাঁধন দেখে আনুমান করতে দ্বিধা হয় না তারাপদ মুন্ডার যৌবনের শক্তিমত্তার বিষয়টি। দাদু সম্বোধনে কথা বলতেই দাঁতহীন মাড়ির গালভরা হাঁসি স্নেহের পরশ বোলাল। ভাল শ্রোতা পেয়ে তাই কথার ঝুড়ি নিয়ে বসলেন তিনি। জানালেন- যুবক বয়সে ৮০-১শ’ কেজি মালামাল মাথায় করে বাহন করতে পারতেন অনায়াসে। তবে সঠিক করে বলতে পারলেন না কত আগে তারা এখানে এসে বসতি গেড়েছেন। ভারতের রাঁচি এলাকা থেকেই এখানে এসেছেন বলেই তিনি অনেক কষ্টে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। তার দাবি, পাগলা সর্দার নামক জনৈক ব্যক্তি সর্বপ্রথম কয়রার বেদকাশি এসে বসবাস শুরু করেন।
কয়রা সদর ইউনিয়নের ১নং কয়রা, মাঝের আইট ,নলপাড়াএবং ৬নং কয়রার টেপাখালী গ্রাম, উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের বতুল বাজার, পশুর তলা, বড়বাড়ি, শেখ সরদার পাড়া, নোনা দিঘীর পাড়, হরিহরপুর ও কাটকাটা, দক্ষিন বেদকাশী ইউনিয়নের বীনাপানি,জোড়শিং এলাকার ১২টি গ্রামে এরা সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করেন। এরা সংখ্যায় প্রায় তিন হাজারের মত। কৃষিকাজ ও দিন মজুরি তাদের মূল পেশা। এছাড়া পশুপালন করেও তারা জীবীকা নির্বাহ করে থাকেন। মুন্ডাদের গোত্রীয় রীতিনীতিও অত্যন্ত চমকপদ। ধর্মীয় রীতিতে এরা জানালেন তারা সনাতন ধর্মাবলম্বী। চার বেদের মধ্যে তারা ঋগবেদের অনুসারী। মুন্ডাদের সবথেকে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পাহাড়িয়া পুজা ও শ্যামা-কালি পুজা। পাহাড়িয়া পুজা হয় পারিবারিকভাবে এবং শ্যামা কালিপুজা হয় গোত্রগতভাবে। ধর্মীয় বিধি নিষেধ থেকেই একসময় মুন্ডাদের সুচিবায়ু ছিল প্রকট। নিজ সম্প্রদায় ছাড়া অন্যের বাড়িতে তারা খাবার খেতেন না। এখন আর সেটি নেই বললেই চলে। বিষয়টি নিয়ে গনেশ মুন্ডা বলেন, এক সময় তারা কুসংষ্কারাচ্ছন্ন ছিলেন। অন্যের বাড়িতে খেতেন না। এখন মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে। অনেক বেশী সচেতন তারা। এ জন্য ওই রীতি এখন আর কেউ মানে না। শিক্ষার বিস্তারে আমূল পরিবর্তন হয়েছে কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি পরিবারগুলোর মধ্যে। শুধু ছেলেরাই নয় মেয়েরাও এখন লেখাপড়ায় বেশ এগিয়ে। মুন্ডাদের মধ্যে প্রায় ১ শ’ ছেলেমেয়ে এখন উচ্চশিক্ষিত। শিক্ষার প্রসার ঘটায় তাদের জীবনযাত্রায়ও বেশ পরিবর্তন এসেছে। তবে তাদের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। ডিগ্রী পাশ প্রভাত মুন্ডা বলেন, চাকরীর বয়স এবার শেষ হবে। বিভিন্ন পদে পরীক্ষা দিয়েছেন প্রায় ২০ বার। কিন্তু চাকরী হয়নি। ভাইভা পর্যন্ত গেলেই টাকার দাবি ওঠে বিভিন্ন স্থান থেকে। অর্থ দেয়ার মত সক্ষমতা না থাকায় তিনি এখনও বেকার বলেই জানান। প্রভাত মুন্ডা ছাড়াও কথা হয় সঞ্জিত, শ্যামসুন্দর, নিরাপদ, জয়দেব সহ একাধিক স্নাতক ডিগ্রীধারীর সাথে। তাদেরও সাফ কথা ‘উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অর্থের অভাবে তারা চাকরী পাচ্ছেন না’। নলপাড়াড় সাধনা মুন্ডা বলেন সে আজ শিক্ষিত হয়ে সমাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বড়বাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এইচএসসির ছাত্রী বা আক্ষেপ-পড়াশোনা শিখে করব কি ? বড় বড় ডিগ্রী নিয়েও তো চাকরী হচ্ছে না। এদিকে জনপ্রতিনিধিদের প্রতিও অভিমান রয়েছে মুন্ডাদের। তারা জানান, শুধুমাত্র ভোটের সময় ছাড়া জনপ্রতিনিধিরা কোন খোঁজ খবর নেন না। নির্বাচনের আগে দেয়া প্রতিশ্রতিগুলো পরবর্তিতে ভুলে যান তারা। বয়স্ক ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত বলেই দাবি করেন এখানকার অনেকে। স্থানীয় ইউপি সদস্য হরেন্দ্রনাথ সরকার মুন্ডাদের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, শিক্ষার বিস্তার ঘটায় মুন্ডারা এখন সচেতন। তিনি সবসময় তাদের সাথে থেকেছেন। এমনকি মুন্ডাদের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বও তিনি পালন করেন। এদের মধ্যে সচতেনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন এনজিও প্রতিনিধিদের উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। এসব কারণে তাদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে, কয়রার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করলেও মুন্ডা সম্প্রদায়কে নিয়ে কারও বিশেষ কোন প্রকল্প নেই বললেই চলে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এনজিও’র কর্মকান্ডের মধ্যে মুন্ডাদের কেউ কেউ সুবিধাভোগী রয়েছেন বলেও জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী সুমিত্রা মুন্ডা বলেন, এক সময় মুন্ডারা নিজেদের বাইরে কোন কিছু চিন্তা করত না। এদের জীবনযাত্রা বিকশিত করতে তারা প্রথমে অন্যান্য মানুষের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা শুর করে। একসময় তারা বোঝাতে সক্ষম হন রাষ্ট্রের কাছে তাদের অনেক অধিকার রয়েছে। অধিকার বিষয়ে সচতনতা বৃদ্ধির কারণে একসময় তারা নিজেদের প্রকাশ করতে থাকে। শিক্ষার গুরত্ব সম্পর্কে তারা অনেক বেশী সচেতন হয়েছে। ফলে ছেলেমেয়েদরকে পরিবার থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছেন। তবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে আদিবাসি সন্তানদের শিক্ষা বৃত্তি,উপবৃত্তি সহ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপকরন দেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল কুমার সাহা বলেন,কয়রার আদিবাসি মুন্ডাদের উন্নয়নে সরকারি ভাবে বিভিন্ন সহযোগিতা করা হচ্ছে।