কপোতাক্ষের কপিলমুনিতে সেতু বাস্তবায়নে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে উচ্চ পর্যায়ের টিম আসছে আজ

0
94
উন্নয়ন অগ্রগতির সোনালী সময়ে ফের স্বপ্ন দেখা একটি সেতু নির্মাণের
শেখ নাদীর শাহ্:


অবশেষে কপোতাক্ষের কপিলমুনিতে সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সরকারের এলজিইডি অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম সোমবার (২১ আগস্ট) প্রকল্প এলাকায় পরিদর্শনে আসছেন বলে দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। এসময় তারা সেখানে সেতু নির্মাাণের সম্ভাব্যতা যাচাই, ডিজাইনসহ বিভিন্ন বিষয়ে নীরিক্ষণ করবেন বলে জানানো হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, এলজিইডির পাইকগাছা উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান।
আর এমন সম্ভাবনায় ভর করে ফের ব্রিজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন জনপদের মানুষ।
সেই ব্রিটিশ শাসনামলে আধুনিক কপিলমুনির রুপকার ও বিনোদগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু জনপদের উন্নয়নে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ তথা বাজার ব্যবস্থাপনায় কপিলমুনিতে গঞ্জ প্রতিষ্ঠা ও তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় কোলকাতার সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থার উত্তোরণে কপোতাক্ষের কপিলমুনিতে একটি সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জনপদের মানুষকে। সেই থেকে শুরু সেতুর জন্য স্বপ্ন দেখা।
এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ২০০০ সালে সরকার গণমানুষের দাবির প্রেক্ষিতে গুরুত্ব বিবেচনায় কপোতাক্ষের উপর কপিলমুনি সেতুর কার্যক্রম শুরু করেও শেষ করতে পারেনি। নানা প্রতিবন্ধকতায় স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয় এর নির্মাণ কাজ। আর এর সাথে অপমৃত্যু ঘটে একটি লালিত স্বপ্নের।
তবে চলতি সরকারের উন্নয়ন অগ্রগতির সোনালী সময়ে ফের উঠে এসেছে সেতু নির্মাণের বিষয়টি। ফাইল চালাচালির এক পর্যায়ে উপরে গুরুত্ব পাচ্ছে এর বাস্তবায়নের বিষয়টি।
ফের শুরু হয়েছে স্বপ্নের বীজ বুনন। কপোতাক্ষের কপিলমুনি কেন্দ্রিক সেতুর বাস্তবায়ন হলে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর থেকে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হবে কপিলমুনির। বর্তমানে দু’টি রোড ক্রস করে ভোমরা থেকে কপিলমুনির দূরত্ব প্রায় ৪০/৪৫ কিলোমিটার। সেতুর বাস্তবায়নে কোন ক্রসরোড ছাড়াই দুরত্ব কমে আসবে অর্ধেকে।
সুন্দরবন উপকূলীয় দক্ষিণের অন্যতম প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র কপিলমুনি কেন্দ্রিক বিনোদগঞ্জ হয়ে উঠবে বহুমাত্রিক বাণিজ্যিক জোন হিসেবে। হাট ও বাজার ব্যবস্থাপনায় যোগ হবে নতুন নতুন এলাকা। যেখান থেকে এর সুবিধা পৌঁছে যাবে সাতক্ষীরার আশাশুনি, তালা, খুলনার পাইকগাছা, কয়রা, ডুমুরিয়া, দাকোপ, বটিয়াঘাটা তথা সরাসরি খুলনার সাথে।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত হিমায়িত চিংড়ি, কাঁকড়া, কুঁচের উৎপাদনস্থল সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট হলেও দীর্ঘ দিনেও এর কোন নির্দিষ্ট জোন গড়ে ওঠেনি। সেতুটিকে কেন্দ্র করে বিস্তির্ণ জনপদের পারষ্পরিক স্বার্থ সুরক্ষায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় গড়ে উঠতে পারে লবণ পানির চিংড়ি জোন হিসেবে। এছাড়া অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় এসব অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের নায্য বাজার দাম থেকে বরাবরই বঞ্চিত হন এখানকার কৃষকরা। সেতুটির বাস্তবায়নে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাথে সড়ক যোগাযোগে ব্যবস্থা স্থাপন হলে বাজার ব্যবস্থাপনায়ও ঘটবে আমুল পরিবর্তন।
এছাড়া ভারত থেকে ভোমরা হয়ে সরাসরি আমদানি পণ্য যেমন পৌঁছে যাবে কপিলমুনিতে তেমনি রপ্তানি পণ্যও সরাসরি পৌছাবে ভারতে। আর সরাসরি আমদানি রপ্তানির বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বানিজ্যিক সম্প্রসারণে নতুন মাত্রায় যুক্ত হবে নতুন নতুন উদ্যোক্তা।
তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, সেতু নির্মাণে এর আগে সরকার ১ কোটি ৯৩ লাখ ৪২ হাজার ৯শ’ ১৯ টাকা ৫৫ পয়সা ব্যয় বরাদ্দ করে। পরে কাজের মানোন্নয়নে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা করা হয়। দরপত্র বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সেতুটির নির্মাণ কাজ পান সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম এ্যাড শেখ মো: নুরুল হকের মালিকানাধীন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এন হক এসোসিয়েট। প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সালে সেতু নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ২০০৩ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত আংশিক কাজ করে আইএফআইসি ব্যাংক খুলনা শাখা থেকে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৭২২ টাকা উত্তোলন করে এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়।
বিষয়টি সেসময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাসহ নানা জটিলতায় বন্ধ থাকে সেতুর নির্মাণ কাজ। এমন পরিস্থিতিতে সেতুর বাকি নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতে অপর একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিলেও সাতক্ষীরা পাউবোর ভ্রান্ত ধারণার উপর ভর করে বিশেষত, কপোতাক্ষ নদের স্রোতে বাঁধা পাওয়ার আশংকার কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক পত্রে এর সামগ্রিক নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়।
সেই থেকে গত ২০ বছর বন্ধ রয়েছে এর নির্মাণ কাজ। এরআগে সেতুর এপ্রোচ সড়ক নির্মাণে দু’পারে জমি অধিগ্রহন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে মাটি ভরাট করে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে পাউবোর আশংকায় সেতু নির্মাণকাজ বন্ধ হলেও নদের বুকে থেকে যায় সেতুর নির্মাণাধীন ১৮টি পিলার। যা পরবর্তীতে কাল হয়ে দাঁড়ায় নদীর জন্য। অতিসত্ত্বর এর নব্যতা হারিয়ে রীতিমত অস্তিত্ব সংকটে পড়ে খরস্রোতা কপোতাক্ষ। ২০১১ সালে কপোতাক্ষের নাব্যতা ফেরাতে সরকার প্রায় ২৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও নদীবক্ষ থেকে অপসারণ করা হয়নি পিলারগুলি।
স্থানীয়রা জানান, কেবলমাত্র সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর ও খেশরা ইউনিয়নের ১৯ টি গ্রামসহ বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাশের সাঁকো পার হয়েই আসে বিনোগঞ্জ (কপিলমুনি) কেন্দ্রীক ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে। বিশেষ করে উৎপাদিত ও নিত্য প্রযোজনীয় পণ্য সরবরাহে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয় সাঁকোটি।
কপিলমুনি বিনোদ স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এ্যাড.দীপঙ্কর সাহা জানান, আধুনিক কপিলমুনির স্থপতি রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু কপোতাক্ষের উপর সেতু নির্মাণে তৎকালীন কোলকাতা রিজার্ভ ব্যাংকে এক লক্ষরও বেশি পরিমাণ টাকা রেখে যান। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত সম্পর্কের অবনতির আগ পর্যন্ত বিনোদ বিহারী সাধু প্রতিষ্ঠিত কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দির ও সিদ্ধেশ্বরী ব্যাংক প্রতি বছর ঐ টাকার লভ্যাংশ হিসেবে অর্ধ লক্ষাধিক টাকা পেত। যা এখন বন্ধ রয়েছে।
সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে স্থানীয় কপিলমুনি ইউপি চেয়াম্যান মোঃ কওছার আলী জোয়াদ্দার জানান, কপোতাক্ষের উপর কপিলমুনি-কানাইদিয়া সেতু নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ¯্রােতধারায় আমরা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখতেই পারি।
দীর্ঘ দিন ব্রীজটির বাস্তবায়ন নিয়ে তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা এক কথায় স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে কাজ করা বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী এস,এম মুস্তাফিজুর রহমান পারভেজ জানান, তিনি দীর্ঘ দিন যাবৎ ব্রীজটির বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, কপোতাক্ষের উপর কপিলমুনি-কানাইদিয়া সেতু নির্মাণে প্রকৃত পক্ষে কোন বাঁধা নেই। সারাদেশে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর যে পরিমাণ উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে তাতে সংশ্লিষ্ট কৃর্তপক্ষের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সহ জনমানুষের সদিচ্ছাই পারে সেতুটির বাস্তবায়নে প্রক্রিয়া এগিয়ে রাখতে।
প্রসঙ্গত, দু’পারের জনপ্রতিনিধিদের ঐক্যবদ্ধ প্রক্রিয়া ও স্থানীয় সৃষ্টিশীল গুটি কতক মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেতুর বাস্তবায়নের বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। যার ধারাবাহিকতায় আজ সোমবার প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা আসছেন খুলনার পাইকগাছার কপিলমুনিতে সেতুটির বাস্তবায়নে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে।
ধারণা করা হচ্ছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কপিলমুনিতে কপোতাক্ষের উপর সেতু বাস্তবায়নে নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকেই আজ ফের কপিলমুনিতে আসছেন এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য।