দেশে খাদ্যপণ্যে ভেজালের ছড়াছড়িতে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বপুলসংখ্যক মানুষ

0
176

টাইমস ডেস্ক:
দেশজুড়ে বর্তমানে খাদ্যপণ্যে চলছে ভেজালের ছড়াছড়ি। চালে মেশানো হ”েছ বিষাক্ত ক্যাডমিয়াম। আটায় চক পাউডার। পোলটি” গোশত ও ডিমে পাওয়া গেছে সহনীয় মাত্রার ৩/৪ গুণ বেশি ক্রোমিয়াম। গরু মোটাতাজা করতে খাওয়ানো হয় স্টেরোয়েড টেবলেট। মাছ, গোশত, দুধ ও ফলে মেশানো হচ্ছে মরণঘাতী ফরমালিন। দুধের ছানার পানির সঙ্গে খাওয়ার সোডা, বিষাক্ত পারঅক্সাইড ও বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হয় কৃত্রিম দুধ। সয়াবিন তেলে মেশানো হয় পাম অয়েল। সরষে তেলে মেশানো হয় মরিচের গুঁড়া, সাবান তৈরির ক্যাস্টার অয়েল ও কেমিক্যাল ঝাঁজ। মিষ্টিকুমড়া-গাজর পিষে, রং, ফেভার ও প্রিজারভেটিভ মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গাওয়া ঘি। মন ভোলানো চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে নামকরা কোম্পানির খাঁটি গাওয়া ঘি বলে দেদার বিক্রি করছে। মরিচের গুঁড়ার সঙ্গে মেশানো হয় ইটের গুঁড়া। ধনের সঙ্গে মেশানো হয় কাঠের গুঁড়া আর ধানের ভূষি। হলুদের রং উজ্জ্বল করতে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। আর এসব খাদ্যপণ্য গ্রহণ করে প্রতিনিয়ত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ। বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন) এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্টে”লিয়ার ওলিংগং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথভাবে গবেষণা জরিপে দেখা যায়, রাজধানীর ৯৬ শতাংশ মিষ্টি, ২৪ শতাংশ বিস্কুট, ৫৪ শতাংশ পাউরুটি, ৫৯ শতাংশ আইসক্রিম ভেজাল বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি। সেক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা করে প্রায় ৫০ শতাংশ খাদ্যপণ্যে অস্বাস্থ্যকর উপাদান পেয়েছে জাতীয় জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া অনেক পণ্যেরই মেয়াদ শেষ হওয়ার জালিয়াতি করে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যই অবাধে বিক্রি করা হ”েছ। তাছাড়া রাজধানীর নামিদামি রেস্টুরেন্টগুলোয়ও রান্না হ”েছ ভেজাল মসলা দিয়ে সুস্বাদু খাবার। ফি”জে রাখা হ”েছ কাঁচা মাংসের সঙ্গে রান্না করা মাংসও। রান্নাঘরও নোংরা ও অস্বা¯’্যকর পরিবেশ। যা জনস্বাস্থ্যর জন্য মারাত্মক হুমকি স”ষ্টি করছে।
সূত্র জানায়, সুস্বা¯ে’্যর জন্য প্রয়োজন স্বা¯’্যসম্মত নিরাপদ খাদ্য। অর্থাৎ ‘সু¯’ খাবার, সু¯’ জীবন’। কিš’ এদেশের প্রায় প্রতিটি খাদ্যেই ভেজালে সয়লাব। গত ৩ বছরে বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ), এলিট ফোর্স র‌্যাব এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন সং¯’া কমবেশি ৮ হাজার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। ওসব অভিযানে ভেজাল প্রমাণিত হওয়ায় প্রায় ২৫ হাজার মামলা হয় এবং প্রায় শতকোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। তার মধ্যে শুধু র‌্যাবের পক্ষ থেকে ৩ বছরে (২০১৮-২০২০) ভেজালবিরোধী অভিযান (মোবাইল কোর্ট) পরিচালনা করা হয়েছে ৪ হাজার ৯২৮টি। আর মামলা হয়েছে ১৬ হাজার ১২৬টি এবং থানায় নিয়মিত মামলা হয়েছে ৯৪টি। ওসব মামলায় জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৭৫ কোটি ১২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮৮ টাকা এবং ১৩ হাজার ২০ জনকে কারাদ- দেয়া হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে বিএসটিআই-এর পক্ষ থেকে প্রায় দেড় হাজার ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২ হাজার মামলা করা হয়েছে। আর জরিমানা আদায় করা হয়েছে সাড়ে ২২ কোটি টাকা। তাছাড়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ চলতি বছর ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে ৬২টি। এর মধ্যে মামলার মাধ্যমে ৪১ ব্যক্তিকে সাজা দেয়া হয়েছে। আর জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৭২ লাখ টাকা।
সূত্র আরো জানায়, পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী শুধু ভেজাল খাদ্যের কারণে প্রতিবছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হ”েছ। তাছাড়া গর্ভবতী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দি”েছ। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাছাড়া বিশ্ব স্বা¯’্য সং¯’ার তথ্যমতে প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসু¯’ হয়। তার মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে ৫ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মারা যায় ১ লাখ ২৫ হাজার।
এদিকে বিএসটিআই গত বছরের মে মাসে খোলাবাজার থেকে ৪০৬টি পণ্যের নমুনা ক্রয় করে। ওসব পণ্য তাদের নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করা হলে ৫২টি পণ্যে ভেজাল পাওয়া যায়। ওসব পণ্যের মধ্যে ছিল সরিষার তেল, চিপস, খাবার পানি, নুডলস, হলুদ ও মরিচের গুঁড়া, আয়োডিনযুক্ত লবণ, লা”ছা সেমাই, চানাচুর, বিস্কুট ও ঘি। পণ্যগুলো বাজার থেকে তুলে নিতে হাইকোর্টের দ্বার¯’ হয় কনশাস কনজুমার্স সোসাইটি নামে একটি বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সং¯’া। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাজার থেকে ওই ৫২টি পণ্য সরিয়ে নিতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশ বাস্তবায়ন করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পণ্যগুলোর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিলে তারা প্রয়োজনীয় ব্যব¯’া নেন বলে জানানো হয়। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আলাদা চিঠি দিলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভেজাল পণ্য বাজার থেকে তুলে নেয়। পাশাপাশি নির্বাহী ম্যাজিস্টে”টরা ভেজাল খাদ্যবিরোধী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা ও মনিটর করছেন।
অন্যদিকে খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা জানান, অসাধু ব্যবসায়ীরা অভিনব কায়দায় খাদ্যে ভেজাল দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে বিদেশ থেকে আমদানি করা গুঁড়া দুধ, চকলেটসহ শিশুখাদ্য, কসমেটিকস আইটেম, ফলমূল মেয়াদোত্তীর্ণ হলে নিজেরাই ১/২ বছর মেয়াদ বাড়িয়ে বিক্রি করে। ওসব অপকর্মে দেশের নামিদামি কোম্পানিগুলোও জড়িত রয়েছে। এ ধরনের বিষয় ধরা পড়ার পর আইন হয়েছে পণ্যের প্যাকেট/কৌটার গায়ে উৎপাদন, প্যাকেটজাত এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ উল্লেখ করতে হবে। তাছাড়া বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও ¯’লবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। যাতে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য দেশে প্রবেশ করতে না পারে। পাশাপাশি খাদ্য ব্যবসায়ীদেরও আরো সচেতন হওয়া জরুরি। প্রয়োজনে তাদের এবং হোটেল শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করা প্রয়োজন। খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান নিয়মিত চালানো। যেখানেই ভেজাল মিলছে, সেখানেই মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি ও জরিমানা করা হ”েছ। তবে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, নিরাপদ খাদ্যের অধিকার জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ভেজাল খাদ্য পরীক্ষা করতে ইতোমধ্যে দেশের আট বিভাগে আটটি আধুনিক ল্যাবরেটরি তৈরির কাজ চলছে। ভেজাল খাদ্যের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।