ভদ্রা সেতু নির্মাণ :দুই দফায় মেয়াদ বাড়ালেও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি

0
451

নিজস্ব প্রতিবেদক :
বছর তিনেক আগে খুলনার দাকোপ উপজেলার ভদ্রা নদীর ওপরে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করেছিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। নির্মাণকাজ ১৮ মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা গত তিন বছরেও শেষ হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশে পরে দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হয়নি। এতে স্বপ্নের ওই সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলের অপেক্ষার প্রহর শেষই হচ্ছে না। আর এলাকার মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ‘গুরুত্বপূর্ণ নয়টি ব্রীজ নির্মাণ প্রকল্পের’ আওতায় বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের ৮ আগস্টে সেতুর নির্মাণকাজ আরম্ভ হয়। কাজ শুরুর ১৮ মাসের মধ্যে কাজগুলো শেষ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেই হিসেবে ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করে এলজিইডি। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আদালতের দারস্থ হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উপজেলার কালিনগর জিসি থেকে খুটাখালি জিসি রাস্তায় শিংজোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে ভদ্রা নদীর ওপর এ সেতু নির্মাণের জন্য ৪২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা প্রাক্কলণ করা হয়। পিটিএসএল মৈত্রী (প্রা.) লিমিটেড নামের ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা চুক্তিতে ওই পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণের কাজ পায়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৩০১ দশমিক ৪০ মিটার এবং ভায়াডাক্ট ১৪০ দশমিক ১৬ মিটার আর সেতুটির প্রস্থ ৭ দশমিক ৩ মিটার। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি খুলনা-১ আসনের সাংসদ ও জাতীয় সংসদের হুইপ পঞ্চানন বিশ^াস নির্মাণকাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
এলাকাবাসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাকোপ উপজেলা বিচ্ছিন্ন তিনটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। দ্বীপ তিনটি ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর পোল্ডার নামে পরিচিত। ৩১ নম্বর পোল্ডারে আছে পানখালি, তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন এবং চালনা পৌরসভা। ৩২ নম্বর পোল্ডারে কামারখোলা ও সুতারখালি ইউনিয়ন এবং ৩৩ নম্বর পোল্ডারে রয়েছে দাকোপ, লাউডোব, কৈলাশগঞ্জ, বাজুয়া ও বানীশান্তা ইউনিয়ন। উপজেলায় একটিও সেতু না থাকায় একটি পোল্ডার থেকে অন্য পোল্ডারে যেতে হলে ওই এলাকার মানুষের নদী পার হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর এজন্য এখনও পর্যন্ত একমাত্র ভরসা খেয়া পারাপারের নৌকা। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর কাদামাটি মাড়িয়ে খেয়া পারাপার হতে হয়। বর্ষাকালে ওই ভোগান্তির সীমা থাকে না। সেতুটি হলে ৩২ ও ৩৩ নম্বর পোল্ডারের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ তৈরি হবে। এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যর গতি বাড়বে।
স্থানীয়রা বলেন, সেতুটি হলে ভোগান্তি কমবে। সুতারখালি ও কামারখোলা ইউনিয়নের উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষিপণ্য বাজুয়ায় ও মোংলার মতো বড় বন্দরহাটে নেওয়া সহজ হবে। সবমিলিয়ে এলাকার যোগাযোগ এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। তবে কাজ তো শেষই হচ্ছে না।
সেতুটি হলে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে সরাসরি সড়কযোগাযোগ স্থাপিত হবে। এছাড়া পাশের উপজেলা পাইকগাছা, কয়রা থেকে মোংলা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুটা সুগম হবে। প্রত্যক্ষভাবে উপকার হবে প্রায় তিন লাখ মানুষের।
গত শনিবার ওই সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্প এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক বিভিন্ন কাজ করছেন। আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে সেতুটি। চারটি স্প্যান বসানো হয়েছে। পঞ্চম স্প্যান বসানোর কাজ চলছে। আর সংযোগ সড়কের জন্য বালু ভরাটের কাজ চলছে।
তবে সেতুটির নির্মাণকাজ ধীরগতিতে চলায় এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। উপজেলার সুতারখালি গ্রামের বাসিন্দা আরব গাজী বলেন, ভদ্রা নদীর এপার ওপারের সাত ইউনিয়নের মানুষ ওই সেতুর মাধ্যমে সরাসরি লাভবান হবে। সেতুটি এই এলাকার মানুষের স্বপ্নের সেতু। আত্মীয়তার সুবাদে এবং পড়ালেখা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা প্রয়োজনে এক পারের মানুষকে অন্য পারে যেতে হয়। সেতুটির কাজ দীর্ঘদিন ধরে চলছে তো চলছে। কবে এটা শেষ হবে তা কে জানে! অবহেলিত এ অঞ্চলের কোনো কাজই তো সময়মতো হয় না।
কালিনগর গ্রামের বাসিন্দা বিশ^জিৎ ম-ল বলেন, এপার ওপার যেতে হলে খেয়াই একমাত্র ভরসা। যানবাহন বলতে খেয়া দিয়ে মোটরসাইকেল পার করা যায়, আর সেটাও ভীষণ কষ্টকর ও ঝঁকিপূর্ণ। আবার রাত সাতটার দিক থেকে আটটার মধ্যে খেয়া বন্ধ হয়ে যায়। তখন দুইপারের মানুষের যোগাযোগ পুরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এলজিইডি খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর সূত্রে, ১৩০ শতাংশ সময় অতিক্রম করার পরও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩৮ শতাংশ হওয়ায় অর্থাৎ আনুপাতিক হারে কাজের ভৌত অগ্রগতি না হওয়ায় ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করে এলজিইডি। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আদালতের দারস্থ হয়ে আদালত থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কাজের সময় বাড়ায়। পরে আদালত আবারও ৩০ অক্টোবর ২০১৯ সময় বাড়ায়। কাগজে-কলমে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সেতুটির ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
সেতুটির শিংজোড়া পারে ১০০ মিটার এবং কালিনগর পারে ১৯০ মিটার সংযোগসড়কের জন্যও আলাদা একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। সে কাজও চলছে ধীরগতিতে।
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মো. মোরশেদ আলম খুলনাটাইমসকে বলেন, মূল সেতু দৃশ্যমান করতে একের পর এক স্প্যান বসছে। এখন পর্যন্ত ১৬টি খুঁটির ওপর চারটি স্প্যান বসেছে। এর মধ্যে ডেক্স সিলাভের ৩টি স্প্যান ও পিসি গার্ডারের ১টি স্প্যানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও একটি ডেক্স সিলাভের স্প্যান নির্মাণ করতে শ্রমিকরা সকল প্রকার প্রস্তুত নিচ্ছে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ৪৩ মিটার। সে হিসাবে এখন পর্যন্ত সেতু দৃশ্যমান হয়েছে প্রায় ২০০ মিটার। তার মধ্যে ১২৯ মিটার পানিতে, যা ৪টি স্প্যান দিয়ে যুক্ত হবে। সেতুর ১৬টি খুঁটির মধ্যে ৫টি খুঁটি পুরোপুরি নদীর মধ্যে। বাকিটা ডাঙায়, রড়কংক্রিট দিয়ে তৈরি হবে। যা ভায়াডাক্ট নামে পরিচিত।
খুলনা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী এএসএম কবির খুলনাটাইমসকে বলেন, ভীষণ ধীরগতির কারণে ওই প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশে আরও দুই দফা বাড়ানো সময়ও শেষের পথে। যেহেতু আদালতের নির্দেশনা আছে তাই আমরা এই মুহূর্তে নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানকে কিছু বলছি না। তবে এখন বেশ ভালো গতিতে কাজ চলছে। এভাবে কাজ চললে সেতুটির নির্মাণ শেষ হতে আরও পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগবে।