সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়া সত্ত্বেও অটোগ্যাসের কাক্সিক্ষত প্রসার ঘটছে না

0
250

টাইমস ডেস্ক:
গাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে সুনাম থাকলেও দেশে অটোগ্যাসের কাক্সিক্ষত প্রসার ঘটছে না। যদিও এ পণ্যটির ব্যবসায় সরকারের নীতিসমর্থন রয়েছে। ব্যবসায়িক দিক থেকেও অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। মূলত গাড়িতে যে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করা হয় তাকেই অটোগ্যাস নামে অভিহিত করা হয়। এ গ্যাসের ক্লিন বা গ্রিন ফুয়েল হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। উন্নত দেশগুলোয় গাড়ির প্রধান জ্বালানিই অটোগ্যাস। উন্নয়নশীল অনেক দেশও তাতে ঝুঁকছে। এর ওজন সিএনজির চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম। পাশাপাশি সিলিন্ডারে চাপ কম থাকায় বিস্ফোরণের ঝুঁকিও অনেক কম। পরিবহনযোগ্য হওয়ায় দেশের যে কোনো প্রান্তেই অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন করা সম্ভব। ওসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সরকারও এখন গাড়ির জ্বালানি হিসেবে সিএনজির বদলে অটোগ্যাসকেই প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। অটোগ্যাস খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০০৫ সাল থেকে দেশে পরিবহনে এলপিজির ব্যবহার শুরু হয়। আর ২০১৬ সালে এ সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করা হয়। কিন্তুগাড়ির জ্বালানি হিসেবে অটোগ্যাসের ব্যবহার শুরুর পর দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও কাক্সিক্ষত মাত্রায় চাহিদা বৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক প্রসার ঘটছে না। বর্তমানে দেশে কতোগুলো গাড়িতে অটোগ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে সে সম্পর্কে কারো কাছে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে ওই সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হবে না। অথচ দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ৪৫ লাখেরও বেশি। আর পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্যানুযায়ী দেশে চলাচলরত গাড়ির সংখ্যা ৩০ লাখের মতো। জ্বালানি হিসেবে ওসব গাড়ি মূলত ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ও সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজি ব্যবহার করা হয়। সরকারের রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) হিসেবে দেশে সিএনজিতে চলা গাড়ির সংখ্যা সাড়ে ৫ লাখ।
সূত্র জানায়, ১৫০০ সিসির একটি গাড়ির অটোগ্যাস ধারণক্ষমতা ৬০ লিটার। একবার ফুল রিচার্জে একটা গাড়ি হাইওয়েতে ৪০০-৪৫০ কিলোমিটার চলতে পারে। ঢাকায় চলতে পারে ৩০০-৩৫০ কিলোমিটার। বিপরীতে সমপরিমাণের এক সিলিন্ডার সিএনজিতে একটি গাড়ি চলতে পারে ৮০-৯০ কিলোমিটার। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম ৪৩ টাকা। আর প্রতি লিটার অটোগ্যাসের বাজার মূল্য ৫০ টাকা। মূল্য বিবেচনায় বর্তমান সময়েই গাড়িতে অটোগ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কিন্তু নানামুখী জটিলতায় অটোগ্যাসের কাক্সিক্ষত মাত্রায় সম্প্রসারণ হচ্ছে না। এজন্য প্রচার-প্রচারণার অভাব, অটোগ্যাস চালুর প্রক্রিয়া ও এ সংক্রান্ত অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা, গাড়ি মালিকদের কনভারশনে অনীহা ও মূল্য সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করা হচ্ছে। সিএনজি থেকে এলপিজিতে একটি গাড়ি কনভারশনে খরচ হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। গাড়িতে সিএনজি সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি নীতি-সহায়তা রয়েছে। কিন্তু এলপিজিতে এখনো ওই ধরনের কোনো সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়নি। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে গ্যাস নেয়ার ঝামেলা না থাকলেও অটোগ্যাস এখনো সহজলভ্য নয়। গোটা রাজধানীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০টি এলপিজি স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বৈশ্বিক পরিবহন জ্বালানি খাতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও অটোগ্যাস ব্যবহার বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে এলপিজি খাতের বেশ কয়েকটি কোম্পানি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজও শুরু করেছে। বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর হাতে পুরোপুরি অটোগ্যাস ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে ওসব প্রতিষ্ঠানের এলপিজি স্টেশন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি, লোকবলসহ অটোগ্যাসের ব্যবসার অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তাছাড়া অনুমোদন পাওয়ার পরও দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হয়ে ওঠছে না। এলপিজি খাতের দেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানি বসুন্ধরা এলপিজি অটোগ্যাস স্থাপনে সারা দেশে ১৭৫টি ফিলিং স্টেশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। তার আওতায় কোম্পানিটি ইতিমধ্যে ৪০টি স্টেশনে অটোগ্যাস সরবরাহ শুরু করছে। আর ১শ’টি ফিলিং স্টেশনে অটোগ্যাস সরবরাহের জন্য ব্যবসায়িক চুক্তি করেছে জি-গ্যাস। তার মধ্যে ৩৫টিতে অটোগ্যাস বিক্রি শুরু হয়েছে। ওমেরা এলপিজি থেকে ২২টিতে ফিলিং স্টেশনে অটোগ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। তার বাইরে বিএম, পেট্রোম্যাক্স ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও বেশ কয়েকটি ফিলিং স্টেশনের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে অটোগ্যাস বিক্রি করছে। অটোগ্যাস বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের মতে, এতোদিন অটোগ্যাস ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে না পারার বড় কারণ হলো সিএনজি ও এলপিজির দামের সমন্বয়হীনতা। আর দামের পার্থক্য থাকলে মানুষ অবশ্যই সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করবে। এখন সিএনজি ও এলপিজির দাম কাছাকাছি। সুতরাং এখন অটোগ্যাস ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এদিকে গাড়িতে এলপিজির ব্যবহার নিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে ‘রিফুয়েলিং স্টেশন, রূপান্তর ওয়ার্কশপ স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা’ জারি করেছে। ওই নীতিমালার আওতায় শুরুতে অটোগ্যাস ব্যবসার জন্য জ্বালানি বিভাগ থেকে অনুমোদন পায় বেক্সিমকো এলপিজি। তার আওতায় কোম্পানিটি ৫০০টি ফ্র্যাঞ্চাইজি ও ২৫টি কনভারশন ওয়ার্কশপ স্থাপনের অনুমতি পায়। ওই নীতিমালা জারির পর গত ৪ বছরে তার আওতায় আরো এক হাজার অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে ৭-৮টি এলপিজি বিপণনকারী কোম্পানি। যদিও তার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৫০টি চালু হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে সিএনজি ফিলিং অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ফারহান নূর জানান, এলপিজি ব্যবহারে কনভারশনের বিষয়টি গাড়ি মালিকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নানা কারণেই এলপিজিতে সুবিধার কথা বলা হলেও অনেকে আগ্রহী হতে পারছে না। দেশে এখন অত্যাধুনিক গাড়ি আসছে। ব্যাটারিচালিত গাড়িও বাজারে এসেছে। এমন অবস্থায় কনভারশন সিস্টেমের প্রতি সরকার উৎসাহিত করলেও বাজারে অনেক অত্যাধুনিক মডেলের গাড়ি রয়েছে, যেখানে ডুয়েল-ফুয়েল সিস্টেম রয়েছে। ফলে যেটি সহজ সেটিই মানুষ গ্রহণ করছে।
এ প্রসঙ্গে এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) সভাপতি ও ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আজম জে চৌধুরী জানান, অটোগ্যাস ইনস্টলেশনে যেসব জিনিসপত্র প্রয়োজন সেগুলো বিদেশ থেকে আনতে হয়। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাছাড়া যেখানে বা যেসব ফিলিং স্টেশনে অটোগ্যাস ইনস্টলমেন্ট দেয়া হয়, সেগুলোর সরকারি অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তাও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তবে তার চেয়েও বড় কারণ হলো সুবিধা ও ইঞ্জিনের স্থায়িত্বের দিক থেকে এলপিজি-সিএনজির পার্থক্য সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করতে না পারা। মূলত ওসব কারণেই অটোগ্যাসের ব্যবসা আগাচ্ছে না। তবে এখন মানুষ এ বিষয়ে জানতে পারছে। যে কারণে ব্যবসায় সম্ভাবনাও জেগেছে।