খেলাপি বাড়ার শঙ্কায় প্রণোদনার ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলোর অনীহা

0
258

টাইমস ডেস্ক:
করোনা মহামারী মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা ঘোষণা করলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। কারণ করোনার প্রভাব কতদিন স্থায়ী হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বর্তমানে এমনিতেই অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হওয়ায় মানুষের আয় কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, উদ্যোক্তাদের পক্ষে ব্যবসা করে ঋণ ফেরত দেয়া কঠিন হবে। সেজন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার প্রভাব মোকাবেলায় প্রণোদনার ঋণ ছাড়ে অনীহা দেখাচ্ছে। কারণ প্রণোদনার অর্থ ফেরত না এলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি ঝুঁকিমুক্ত উদ্যোক্তা বাছাইয়ে ব্যাংকের সক্ষমতার অভাবেও ঋণ বিতরণে অনাগ্রহ কাজ করছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনার প্রভাব থেকে কতদিনে অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার অভাব। যে কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনার ঋণ বিতরণ করে ঝুঁকির মাত্রা বাড়াতে চাচ্ছে না। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। যদিও করোনার প্রভাব মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নে নানামুখী ছাড় দেয়া হয়েছে। তারপরও ব্যাংকগুলো বিশেষ করে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কোনো ঋণ দিচ্ছে না। শুধু বড় উদ্যোক্তাদের কিছু ঋণ দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রণোদনা বাস্তবায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তদারকি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। ফলে মার্চের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। মার্চে এর পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। তার বিপরীতে প্রভিশন ও স্থগিত সুদ বাবদ আটকে আছে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশের বেশি থাকলেই ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। সেখানে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সোয়া ৯ শতাংশেরও বেশি। ফলে এমনিতেই দেশের আর্থিক খাত ঝুঁকিতে রয়েছে। তার মধ্যে প্রণোদনার ঋণ ছাড় করার কারণে খেলাপি ঋণ আরো বৃদ্ধি পেলে ঝুঁকির মাত্রাও বেড়ে যাবে।
সূত্র আরো জানায়, করোনায় বিশেষ করে কুটির ও ছোট উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকা- স্বাভাবিক করতে দ্রুত টাকার জোগান দেয়া প্রয়োজন। তাহলেই দেশের অর্থনীতি দ্রুত পুরোদমে সচল হবে। কারণ প্রণোদনার ঋণ এ সময়ে অনেকেরই খুব উপকারে আসছে। অবশ্য তাতে কিছুটা ঝুঁকিও রয়েছে। কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে হলেও ছোটদের কাছে টাকা পৌঁছাতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে না।
এদিকে ব্যাংকারদের মতে, কুটির ও ছোট ব্যবসায়ীরা সাধারণত ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় না। নিজের টাকায় ব্যবসা করে। তবে করোনার কারণে তাদের নতুন করে পুঁজির প্রয়োজন পড়েছে। অনেকেই ব্যাংকের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু উদ্যোক্তাদের বাছাই করার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছে। একদিকে তাদের সাথে ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে তাদের সম্পর্কে ব্যাংককে নতুন করে জানতে হচ্ছে। পাশাপাশি দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে ঋণ দিলে যাতে ফেরত আসে। কারণ এক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রাটা বেশি। তাছাড়া করোনায় মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান কমার কারণে চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। ফলে পণ্য উৎপাদন করে উদ্যোক্তারা এখন সেগুলো বিক্রি করতে পারবে না। ফলে উদ্যোক্তাদের টাকাও আটকে যাবে। তখন তারাও ঋণ শোধ করতে পারবে না। সব মিলে প্রণোদনার অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে ঝুঁকি রয়েছে।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকগুলো আগেই খেলাপি ঋণে ডুবে আছে। এখন তাদের ভয় প্রণোদনার ঋণ বিতরণ করলে খেলাপি ঋণ যদি আরো বেড়ে যায় তখন আরো খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কম থাকলে বর্তমানে তারা বেশি ঝুঁকি নিতে পারতো। কিন্তু খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ায় এখন ঝুঁকি নিয়ে ঋণ বিতরণ করতে তারা সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু প্রণোদনা বাস্তবায়ন করতে হলে এখন ব্যাংকগুলোকে সাহস দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিও জোরদার করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দেবে আর বাণিজ্যিক ব্যাংক সেটা মানবে না তা হতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর একাধিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, প্রণোদনার ঋণ বিতরণে শর্ত অনেক শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু মূল শর্তটি শিথিল করা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী প্রণোদনার ঋণ বিতরণের পর আদায় দায়িত্ব ব্যাংকারদের। এ দায়িত্ব কোনোভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেবে না। কোনো কারণে ঋণ আদায় না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ৫০ শতাংশ অর্থের জোগান দেবে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত হিসাব থেকে কেটে নেবে। ঋণ পরিশোধ না হলে তা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। তখন এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হবে। তাতে আটকে যাবে ব্যাংকের টাকা। তখন একদিকে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় আরো বেড়ে যাবে, অন্যদিকে তারল্য সংকট বাড়বে। তাই প্রণোদনার ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।
এ বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী জানান, করোনার কারণে প্রায় ২ মাস ব্যাংকিং কার্যক্রম খুবই সীমিত ছিল। এখন পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ঋণ বিতরণ বাড়াতে ব্যাংকগুলো নানা চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর টাকা দিতে হলে কিছু নিয়ম-কানুন মানতে হয়। বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই সেগুলো মানতে পারছে না। যে কারণে প্রণোদনার ঋণ বিতরণে দেরি হচ্ছে।