রাজনীতি-অর্থনীতির চাকা চলুক সততায়-মেধায়-যোগ্যতায়…

0
316

মোমিন মেহেদী,
সারাদেশে সমস্যার জাল। ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিটি সেক্টরে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে নোংরা রাজনীতির প্রভাব বিস্তার করেছে। যে কারণে আজ আর্থিক খাতে ভারসাম্যহীনতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ খাতের বিভিন্ন সূচকে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। একটির সঙ্গে অন্যটি মিলছে না। এর ফলে একের পর এক নানা ধরনের সংকট দানা বাঁধছে। একটির সমাধান হতে না হতেই আরেকটি এসে হাজির। তারল্য সংকট, মাত্রাতিরিক্তি খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, নাজুক ঋণ আদায় পরিস্থিতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, টাকা পাচারের মতো নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আর্থিক খাত এখনও মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। শুধু এখানেই শেষ নয়; আমাদের অর্থনীতিকে করা হয়েছে দেউলিয়া। অবশ্য সেই সূত্রতায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে নেমেছে প্রশাসন; দীর্ঘদিন পরে হলেও।
১৮ সেপ্টেম্বর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তল্লাশি করা হচ্ছে। এতে অনেকের ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ তোলা বা স্থানান্তরে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে অনেকেই টাকা তুলতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। আতঙ্কগ্রস্তরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। অনেকে নগদ টাকা ব্যাংকে না রেখে বিদেশে পাচার করছেন। এতে করে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকেও বাড়ছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ায় তারল্য সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলা ভালো। এটি চালাতে গিয়ে আর্থিক খাত থেকে সন্দেহভাজনদের সম্পদের তথ্য নেয়ার ওপর জোর দেয়া মোটেও উচিত হবে না। বরং গোয়েন্দা মাধ্যমে সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো উদ্ধারে জোর দেয়া উচিত। আর্থিক খাত থেকে তথ্য নিতে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাবের তল্লাশি চালানো হলে এর নেতিবাচক প্রভাব অনেক গ্রাহকের মধ্যে পড়বে। তখন তারা টাকা রাখবে না। তখন তারল্য সংকট প্রকট হবে। যেমনটি হয়েছিল ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চলা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময়। সে অভিজ্ঞতা থেকে এবারও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। গণমাধ্যম রেকর্ড বলছে- ওই সময়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও তথ্য তলব ছিল নিয়মিত ঘটনা। এতে কিছু গ্রাহকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে তারা টাকা রাখা যেমন কমিয়ে দেয়, তেমনি জমা টাকাও তুলে নিতে থাকে। এতে আর্থিক খাতে বড় ধরনের তারল্য সংকট দেখা দেয়। অবশ্য অভিযানের শুরুতে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব জব্দ বা তথ্য তলব করার ঘটনা বেশি মাত্রায় ঘটলেও এখন তা কমে এসেছে। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনো গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করবে না। প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে কারও ব্যাংক হিসাব জব্দ করবে না। ফলে এখন হিসাবের তথ্য চাওয়ার প্রবণতাও কমে গেছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের কোনো অভিযোগ পেলে বিএফআইইউ সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের হিসাবের তথ্য চায়। তারা নিজ ক্ষমতায় কোনো গ্রাহকের হিসাব ৩০ দিন জব্দ করে রাখতে পারে। এর মেয়াদ আরও ছয় মাস তারা বাড়াতে পারে। তবে এর বেশি রাখতে হলে আদালতের অনুমোদন লাগে। এর বাইরে এনবিআর রাজস্ববিষয়ক তদন্তে হিসাবের তথ্য চাইতে ও জব্দ করতে পারে।
যতদূর জানি- দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সন্দেহভাজনদের বিষয়ে তদন্তের জন্য হিসাবের তথ্য চাইতে পারে। এছাড়া আদালত তথ্য চাইতে ও জব্দ করতে পারে। আমি অবশ্য সেইসাথে বলতে চাই- বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী- চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে আমানত সংগ্রহের চেয়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে বেশি। সাধারণত প্রচলিত ব্যাংকগুলো আমানতের ৮৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো ৯০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। বাকি অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে বিধিবদ্ধ আমানত হিসাবে জমা রাখতে হয়। এছাড়া আরও কমপক্ষে দুই থেকে তিন শতাংশ অর্থ নিজেদের কাছে রাখতে হয় নগদ লেনদেনের জন্য। এ হিসাবে ব্যাংকগুলো ৮২ থেকে ৮৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলো এর চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ফলে অনেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এতে সামনের দিনগুলোতে তারল্য সংকট আরও বাড়তে পারেও আমি আশঙ্কা করছি। কেননা, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে দুই দশমিক তিন শতাংশ। একই সময়ে আমানত বেড়েছে এক দশমিক চার শতাংশ। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে এক শতাংশ বেশি। বাস্তবে আমানতের চেয়ে ঋণ বিতরণ কম হওয়ার কথা ছিল। এর প্রভাবে আর্থিক খাতে নগদ টাকার চাহিদা বেড়েছে। ফলে কলমানি (এক দিনের জন্য এক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যে ধার নেয়) থেকে ধার করার প্রবণতা বাড়ছে। এতে কলমানির রেট বেড়েছে।
অর্থনতির রেকর্ড বলছে- গত বছরের ১৬ অক্টোবর কলমানির রেট ছিল তিন দশমিক ৬৭ শতাংশ। ৩০ সেপ্টেম্বরে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। ১৬ অক্টোবর ছিল চার দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ সময়ে কলমানি রেট সাধারণত আরও কম থাকে। এই অবস্থায় কলমানির হার বাড়লেই বুঝতে হবে আর্থিক তারল্য সংকট হয়েছে। এর কারণেই কলমানি রেট বাড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে আর্থিক খাতে তারল্য সংকট রয়েছে। এ সংকট নিরসনে আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে হবে।
তাছাড়া যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, রেমিটেন্স প্রবাহ সামান্য বাড়লেও রফতানি আয় কমে গেছে- যা তারল্য ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি করেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় বেড়েছিল ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সেহেতু ভাবতে হবে সমাধানের জন্য। তার উপর চলতি অর্থবছরে বাড়ার পরিবর্তে আরও দুই দশমিক ৯৪ শতাংশ কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় বেড়েছিল ৫৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে সাত দশমিক ৩০ শতাংশ কমেছে। এতে রফতানিকারকদের মধ্যে তারল্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আরো হাশার বিষয় হলো- বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট বিরাজ করছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ফলে অনেকে টাকা পাচার করছেন। এ কারণে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে তিন টাকা বেড়ে গেছে। এ মাসের শুরুর দিকে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হতো ৮৪ টাকা করে। এখন তা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৮৭ টাকা করে। আগে কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকে ডলারের দর প্রায় একই ছিল। এখন ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটের ব্যবধান প্রায় সাড়ে তিন টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকের চেয়ে সাড়ে তিন টাকা বেশি দরে কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে। তবে বরাবরের মত বলতে চাই- এভাবে বাংলাদেশকে খাদের কিনারে যারা নিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে জাগুন। অর্থনীতি ধ্বংসের এই সময়ে যখন অবৈধভাবে ডলার ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় তখন কার্ব মার্কেটে এর চাহিদা বাড়ে। এতে দাম বেড়ে যায়। কার্ব মার্কেটে ডলারের চাহিদা বাড়া মানেই দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। ব্যাংকের চেয়ে কার্ব মার্কেটে দাম বেশি বেড়ে গেলেই বুঝতে হবে অবৈধ কিছু হচ্ছে। তখন অর্থনৈতিকভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া ব্যাংকেও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বাড়িয়েছে। গত বছরের ১৬ অক্টোবর ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ৮৩ টাকা ৮৩ পয়সা। এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এর দাম আরও বেশি। তবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে সবাইকে ভাবতে হবে বলে আমি মনে করি। কেননা, একদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ডলারের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে বেড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। বর্তমানে এর পরিমাণ তিন হাজার ২১৭ কোটি ডলার। গত জুনে ছিল তিন হাজার ২৭৮ কোটি ডলার। রিজার্ভের পরিমাণ বেশি থাকলে সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল থাকে। এমন একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থায় আবার চলছে ছলচাতুরির খেলা। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এটিএম (টাকা উত্তোলনের মেশিন) ও সিআরএম মেশিন (টাকা উত্তোলন ও জমা) আমদানির নামে অর্থ পাচার করেছে জারা জামান টেকনোলজি লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের শুল্কও ফাঁকি দিয়েছে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগের পর তা খতিয়ে দেখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
গণমাধ্যম অবশ্য বলছে- জারা জামান টেকনোলজি লিমিটেড ২০১৮ সালের ২২ অক্টোবর চীনের জিআরজি ব্যাংকিং ইকুইপমেন্ট (এইচকে) নামের একটি কোম্পানির কাছ থেকে ৩২ পিস এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) এবং ১৭ পিস সিআরএম (ক্যাশ রিসাইক্লার মেশিন-টাকা উত্তোলন ও জমা) মেশিন ক্রয় করে। কোম্পানির চালান মূল্যে দেখা গেছে, প্রতিটি এটিএমের ক্রয়মূল্য ৩ হাজার ৫৭০ ডলার। সে হিসাবে ৩২টি এটিএমের মোট মূল্য ১ লাখ ১৪ হাজার ২৪০ ডলার। কিন্তু এলসিতে প্রতিটি এটিএমের মূল্য দেখানো হয়েছে ১১শ’ ডলার। সে হিসাবে ৩২টি এটিএমের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৩৫ হাজার ২শ’ ডলার। একইভাবে, প্রতিটি সিআরএম মেশিনের ক্রয়মূল্য ১২ হাজার ৫৫০ ডলার। সে হিসাবে ১৭টি সিআরএম মেশিনের মূল্য ২ লাখ ১৩ হাজার ৩৫০ ডলার। কিন্তু প্রতিটি সিআরএম মেশিনের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৫শ’ ডলার। সে হিসাবে ১৭টি সিআরএম মেশিনের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৪২ হাজার ৫শ’ ডলার। সেই সাথে ওই কোম্পানির শর্তে বলা হয়, পণ্য সরবরাহের পূর্বে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে। ঢাকা মহাখালীর ২ বীর উত্তম একে খন্দকার সড়কের ঠিকানায় পণ্যগুলো আমদানি করা হয়েছে।
আমি মনে করি অর্থ লুটপাটের এদশে সবাই এখন নোংরা রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনীতির চাকাও ঘোরাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিে প্রতিষ্ঠানটি আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে ২ কোটি টাকার বেশি (৭৯ হাজার ৪০ ডলার ও ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৩০ ডলার) পাচার করেছে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্বও ফাঁকি দিয়েছে।
এই সকল কিছুতে রয়েছে রাজনীতিকে অপব্যবহারের চেষ্টা। রয়েছে কুরাজনীতি-অর্থনীতির প্রভাব। মুক্তির পথ একটাই ঘুরে দাঁড়ানো সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সৎ হতে হবে, সৎ তৈরি করতে হবে, সততায় এগিয় যেতে হবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে বিনয় আর আলো আশায়-ভালোবাসায়। যাতে আমাদের রাজনীতি হয় স্বচ্ছ-থাকে স্বচ্ছ। অর্থনীতি থাকে দুর্নীতির বাইরে…
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি