দেবহাটায় সফলতা পাওয়া ৫ সংগ্রামী নারীর জীবন কাহিনী

0
854

দেবহাটা প্রতিনিধি:
সমাজ, পরিবারের নানা বাধা কাটিয়ে জীবনের সফলতা পেয়েছেন দেবহাটার ৫ নারী। তৃণমূল থেকে উঠে আসা ৫টি ক্যাটাগরীতে সফল নারীদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’’ শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় খুঁজেবের করে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। এসব নারীদের আত্মতৃপ্তি ও অনুস্মরনীয় করতে ২০১৮ সালের ০৯ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবসের তাদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। এদের জীবনে রয়েছে আলাদা আলাদা জীবন কাহিনী। সেই সংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরা হলো:
শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী: একজন শিশু কন্যা থেকে সফল নারী আফসানা মমতাজ। সে উপজেলার মাঘরী গ্রামের সাইফুল্লাহ আল-তারিকের স্ত্রী। ১৯৮১ সালে সে কলারোয়া উপজেলার তুলসীডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহন করে। তার পিতা মৃত আলী আহমদ ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের একজন মুহুরী। পিতা মাতার ৪ সন্তানের মধ্যে আফসানা তৃতীয়। একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসাবে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কলারোয়া গার্লস পাইলট হাইস্কুল থেকে ১৯৯৭ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি তে প্রথম বিভাগ, ১৯৯৯সালে শেখ আমানুল্লাহ ডিগ্রী কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্হস্থ্য অর্থনীতি (গৃহ ব্যবস্থাপনা ও গৃহায়ন) বিষয়ে ২০০৬ সালে ১ম শ্রেণিতে বিএসসি(সম্মান) এবং ২০০৭ সালে এমএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন। পড়ালেখা শেষ করে তিনি ২০০৯ সালে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ২০১১ সালে দেবহাটা উপজেলার মাঘরী গ্রামে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। সংসারের কাজের পাশাপাশি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সৎ, নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন আফসানা। বর্তমানে সে এক পুত্র সন্তানের জননী। তিনি মনে করেন উন্নত জীবন গঠনের স্বপ্ন নিয়ে দৃঢ় মনোবলের সাথে কঠোর পরিশ্রম করলে সফলতা অর্জন সহজ।
সফল জননী: একজন সফল জননী শাহানার খাতুন। সে উপজেলার পাঁচপোতা গ্রামের আব্দুল করিমের স্ত্রী। তার পিতার পরিবারের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। দারিদ্রতায় বেশি লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি তার। কোন রকম স্কুলের গোন্ডি পার হওয়ার পূর্বে বিয়ে দেওয়া হয় আব্দুল করিমের সাথে। এরপর স্বামীর সংসারে ৫ কন্যা ও এক পুত্রের জননী হন তিনি। দারিদ্রতায় হার না মেনে স্বামীর সাথে সংসারের হাল ধরেন শাহানার। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে করে চলেছেন। তার সন্তানেরা স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করছেন। তাদের প্রথম কন্যা কবিতা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এম.এ পাশ করে ঢাকা কলেজে প্রভাষক হিসাবে কর্মরত আছেন। ২য় কন্যা মনিরা পারভীন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে এম.এ পাশ করে ন্যাশনাল সার্ভিসে কর্মরত আছেন। ৩য় কন্যা শিউলী কানন সাতক্ষীরা সিটি কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ পাশ করে দিবা-নৈশ্য কলেজের প্রভাষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ৪র্থ কন্যা আজমিরা পারভীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম.এ পাশ করেন এবং বর্তমানে সে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। ৫ম কন্যা শাপলা পারভীন যশোর এম.এম কলেজে অধ্যায়নরত আছেন। এছাড়া শাহানারার একমাত্র পুত্র সাইফ আল জাকির সখিপুর সরকারি কেবিএ কলেজে মাধ্যমিক পর্যায়ে অধ্যায়ন করছে। তাদের এই প্রচেষ্টাকে স্থানীয়দের অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নব উদ্দ্যমে জীবন শুরু: নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন জীবন শুরু করেছেন মাছুরা খাতুন। সে পারুলিয়া ইউনিয়নের খেজুরবাড়িয়া গ্রামের সাইদুল ইসলামের স্ত্রী। পারিবারিক ভাবে ১৮ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর জানতে পারে তার স্বামী একজন নেশাগ্রস্থদের মধ্যে একজন। তার স্বামী নেশার টাকা জোগাড় না করেতে পেরে স্ত্রীকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। মাছুরার প্রথম সন্তান জনগ্রহনের পর নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। কারনে অকারনে তার উপর চালানো হত নির্যাতন। কয়েক বছর পর জন্ম দেয় আরো একটি সন্তান। এসময় নির্যাতনের মাত্রা এতটা বৃদ্ধি পায় যে স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর সে খুব কষ্টের মধ্যে কাটাতে থাকে এবং জীবিকার তাদিকে সে শুরু করে পোল্ট্রির চাষ। এতে তার জীবনের মোড় ঘুরে দাঁড়ায়। বর্তমান সে পোল্ট্রি মুরগী চাষ করে স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছে। সমাজে তার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। মাছুরার সুদিন ফিরেছে।
অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী: অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছলতা ফিরেছে খাদিজা খাতুনের। সে পারুলিয়া ইউনিয়নের সেকেন্দ্রা গ্রামের আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী। বিয়ের পর তার স্বামীর পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না। খেয়ে না খেয়ে তার অধিকাংশ দিন কাটত তার। কয়েক বছর পর স্বামী মারা যাওয়ার পর তার পরিবারে নেমে আসে অঘোর কালো ছায়া। এরপর সে একবিঘা জমি লিজ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করে। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে চাষকৃত মাছ থেকে বেশ মুনফা পায়। ধীরে ধীরে সে জমির পরিমান বাড়াতে থাকে আর বর্তমানে সে ৫০ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করছে। তার পরিবার এখন সুখে শান্তিতে বসবাস করছে।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান : সুফিয়া খাতুন। স্বামী: মৃত রিয়াজউদ্দীন। সে টাউনশ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। ১৯৮০ সালে বিয়ের হবার পর থেকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আমাকে জীবন নির্বাহ করতে হয়। এর মধ্যে ২০০০ সালে আমার স্বামী মারা যায়। দারিদ্রের কারণে মেয়োটকে লেখাপড়া শেখাতে না পারলেও ছেলেটির লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে তার ছেলে সাতক্ষীরা সরকারী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। স্বামী মারা যাওয়ার পর দারিদ্র এবং হতাশার অন্ধকার থেকে বের হয়ে বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের সহযোগিতায় টাউনশ্রীপর পল্লী সমাজের সদস্য হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন সুফিয়া। একপর্যায়ে সমাজের নানাবিধ কুসংস্কার ও বাধা বিপত্তি দুর করতে জন্য ২০১১ সালে গ্রামের দুঃস্থ নারীদের সংগঠিত করেন টাউনশ্রীপুর বহুমূখী পল্লী সমাজ ফাউন্ডেশন নামক একটি মহিলা সমিতি। সংগঠনটি ২০১২ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৮০ জন। আর এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার তাদের প্রচেষ্টায় ও উপজেলা প্রশাসন এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ৩৫ টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন তারা। এছাড়া রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা এবং মূমূর্ষু রোগীদের জন্য রক্তদান কর্মসূচী চলমান রয়েছে তাদের। চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচার প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গোপন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন তাদের সংগঠন। এভাবে সমাজে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন সুফিয়া খাতুন।