জীবনের পড়ন্ত বেলায় স্ত্রীর দাবি, মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর নাম গেজেট অন্তর্ভূক্তি

0
222

নিজস্ব প্রতিবেদক:
বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মস্থল থেকে স্পিড বোডসহ পালিয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলেন আব্দুল জলিল। দেশকে শত্রæমুক্ত করতে সেদিন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। পাউবোর পাইকগাছা অফিসের তৎকালীণ পাম্প ড্রাইভার হিসেবে মাস্টার রোলের কর্মচারী আব্দুল জলিল মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি স্বরুপ সনদ পেলেও তাকে গেজেটভূক্ত করা হয়নি স্বাধীনতার ৫০ বছরেও। ১৯৯২ সালের ২৭ মার্চ দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় তাঁর। সেদিন পাউবোর কর্মকর্তারা তাঁর ৬ দিনের বেতন বাবদ ৫৫০ টাকা ও চাকুরীরর কিছু কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পরিবারকে।
জীবদ্দশায় চাকুরীটা জাতীয় করণ না হলেও মৃত্যুর ৩ বছর পর ১৯৯৫ সালে জাতীয়করণ হয়। তবে সেই খবরটিও পরিবার পায় মৃত্যুর ২০ বছর পর। যদিও তাঁর পরিবার অবসরভাতা পায়নি অদ্যবধি। অফিসকে অবহিত না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ায় সেদিন তাকে চাকুরি জাতীয়করণের বদলে অন্যত্র বদলী করা হয়। স্বাধীনতার পর মাস্টাররোলে চাকুরিতে যোগদানকৃতদের জাতীয়করণ হলেও জাতীয়করণ হয়নি তার চাকুরি। ৯ জনের সংসারে আজীবন চরম কষ্ঠে জীবন-যাপন করেছেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানদের ঠিকমত পেটভরে কখনো খাবার জোটাতে পারেননি। উ”চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেননি সন্তানদের কাউকে।
মোঃ আব্দুল জলিল গাজী খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের বর্তমানে পাইকগাছা পৌরসভার (১ নং ওয়ার্ড) মরহুম মোহর আলী গাজীর ছেলে। মাতা নবিজান বিবি ছিলেন গৃহিনী। অভাব অনটনে তিনিও পড়া-লেখায় বেশিদূর এগোতে পারেননি।
কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাইকগাছা অফিসের পাম্প ড্রাইভার হিসেবে মাস্টাররোলে চাকুরি করতেন। যুদ্ধকালীণ ১৯৭১ সালের ১০ জুন তিনি চাকুরির মায়া ত্যাগ করে ও স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে অফিসের স্পিড বোডটি নিয়ে যোগ দেন মুজিব বাহিনীতে। ৯ নং সেক্টরের অধিনে হাতিয়ার ডাঙ্গা ক্যাম্পে ট্রেনিং গ্রহন করেন তিনি। এরপর ট্রেনিং শেষে তিনি মুজিব বাহিনীর কমান্ডার শেখ শাহদাৎ হোসেন বাচ্চুর নেতৃত্বে কপিলমুনি কেয়ারগাতী ও খুলনা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ফের বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র রাইফেল-৩০৩ জমা দেন।
১৯৮৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর চাকুরিটি জাতীয় করণের দাবিতে তৎকালীন রাষ্ট্র প্রধান হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এর নিকট আবেদন করেন। এর পরি প্রেক্ষিতে ২৪/০৯/ ১৯৮৮ পাউবোর সচিব স্বাক্ষরিত আবেদনের ফাইলটি প্রেরণ করা হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। এরপর ১৯৯২ সালের ২৭ মার্চ দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর।
স্বাধীনতার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কর্তৃক “স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র ” দেয়া হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জলিল কে। যার নং- ৪৩৫৫০। এরপর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল ও তার পরিবার পর্যায়ক্রমে ১৯৯২, ১৯৯৬ ও ২০০৪ সালের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইতে অংশ নিলেও ফল আসেনি। ২০১৭ সালের মুক্তিযোদ্ধা যাচাইবাছায়ে অংশ নেন তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বেগম। সেবার যাচাই-বাছাই কমিটির সাত সদস্যের ৬ জনই আব্দুল জলিলকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মতামত দিলেও কমিটির সভাপতি খুলনার তেরখাদা থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা এড. মুজিবর রহমান দ্বিমত পোষণ করায় (খ) তালিকাভূক্ত হয় জলিলের নামটি। পরে তাঁর স্ত্রী (খ) তালিকারভূক্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করেণ। যার নং ৪৬৪১/১৭ ইং। অদ্যাবধি পিটিশনটি চলমান রয়েছে। আব্দুল জলিলের জামুকা রেজি: নং-৬৮৪।
পারিবারিক সূত্র জানায়, আব্দুল জলিলকে ১৯৮৪ সালে পাইকগাছা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুবল চন্দ্র মন্ডল, ২০০৬ সালে শেখ শাহদাৎ হোসেন বাচ্চু, যুদ্ধকালীণ কমান্ডার গাজী রুহুল আমিন, ২০১০ সালে যুদ্ধহাত মুক্তিযোদ্ধা শেখ বেলাল উদ্দীন বিলু, ২০১২ সাবেক কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ, ২০১৬ সালে খুলনা জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান কামরুজ্জামান টুকু, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সরদার মাহবুবর রহমান, যুদ্ধকালীণ কমান্ডার কোরবান আলী, সহকারী কমান্ডার আব্দুল আলী, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রওশন আলী খাঁ, অমল বৈরাগী প্রকৃত মুজিব বাহিনীর সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যায়ন পত্র দিলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অদ্যবধি গেজেটভূক্ত হননি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিলের বৃদ্ধা স্ত্রী রোকেয়া বেগম আক্ষেপের সাথে বলেন, একজন প্রতিবন্ধীসহ ৭ জন সন্তানদের নিয়ে অত্যন্ত কষ্ঠে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। কোন জমি জায়গা না থাকায় পাইকগাছা পানি উন্নয়ন বোর্ডের যায়গায় কলোনিতে কুড়ে ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। জীবনের পড়ন্ত বেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ.খ.ম মোজাম্মেল হক ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ’র নিকট তাঁর করুণ আকূতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বামী আব্দুল জলিলের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি। মৃত্যুর আগে হলেও স্বামীর গেজেটভূক্তির কাগজে হাত বুলাতে চান মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা স্ত্রী রোকেয়া বেগম।