চলমান রোহিঙ্গা সংকটের ১ বছর: প্রত্যাবাসন কতদূর প্রভাবশালী বন্ধু দেশগুলোর কার্যকর ভূমিকা চাই

0
591

খুলনাটাইমস ডেস্কঃ

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা তৎপরতা সত্ত্বেও বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠিক কবে শুরু হবে, তা বলতে পারছেন না কেউ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বন্ধু দেশগুলোর কাছ থেকে যে ধরনের উদ্যোগ প্রত্যাশিত ছিল, তা পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মিয়ানমারের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি দেশটির ওপর। কারণ চীন, রাশিয়া, জাপানের মতো দেশগুলো ঐক্যবদ্ধভাবেই মিয়ানমারকে চাপ এড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় প্রভাবশালী বন্ধু দেশগুলোর আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। আর তার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরালো করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয়। তবে দ্রুতই এ প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। কারণ অন্যান্য ইস্যুর মতো রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুটি হারিয়ে যায়নি। বরং এক বছর পরও আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে পূর্ণ সক্রিয় এবং নানাভাবে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে মিয়ানমারের ওপর। এটা সঠিক পথে এবং ধারাবাহিক কূটনৈতিক তৎপরতার কারণেই সম্ভব হয়েছে।

রোহিঙ্গা কূটনীতি যেখানে দাঁড়িয়ে: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা কূটনীতির সর্বশেষ অগ্রগতি চলতি আগস্ট মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর মিয়ানমার সফর। দেশটির স্টেট কাউন্সেলরের ইউনিয়ন মন্ত্রী কিয়াউ টিন্ট সোয়ের আমন্ত্রণে এ সফর হয়। সফরকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংকট শুরুর পর প্রথমবারের মতো রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করেন। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীরা সরেজমিনে দেখেছেন, রাখাইনে ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে নেপিদোতে মিয়ানমারের একাধিক মন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। বৈঠকে মিয়ানমারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বক্তব্য ইতিবাচক ছিল। কীভাবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায়, কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কীভাবে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী করে তোলা যায়, তার প্রক্রিয়া নিয়েও তারা কথা বলেন। তবে সংকটের টেকসই সমাধান নিশ্চিতে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গাদের নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করার প্রশ্নে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ছিল আগের মতোই নিশ্চুপ।

সংশ্নিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে রাখার জন্য ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করা হলেও রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে এখনও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রয়েছে। গ্রামগুলোকে বাসযোগ্য করার কোনো উদ্যোগ নেই। এ ছাড়া গ্রামের ভেতরে দীর্ঘ বিস্তৃত কাঁটাতারের বেড়াও দেখা যায়। কেন এই বেড়া জানতে চাইলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে একটি বড় রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল স্থাপনের জন্যই এ বেড়া দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে মিয়ানমারের এখন পর্যন্ত ভূমিকা পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, চলতি বছরের মধ্যেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না।

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এক বছর ধরেই রোহিঙ্গা পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য ধারাবাহিকভাবে জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো হচ্ছে। এ সংকট কীভাবে ক্রমাগত বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে, তাও তুলে ধরা হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ চাইছে, এবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পর এ সংকটের যেন আর অবশেষ না থাকে। তাই আন্তর্জাতিকভাবে শুধু প্রত্যাবাসন নয়, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত করার বিষয়টিকেও কূটনীতিতে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির বেড়াজাল: বর্তমানে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বৈশ্বিক বিভাজন দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। এ সংকটকে পুঁজি করে বিশ্বের প্রভাবশালী বলয়গুলো নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ আরও বেশি সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল।

তারা বলছেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইইউ রোহিঙ্গা সংকটকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান শরণার্থী সংকট হিসেবে দেখছে এবং রাখাইনে গণহত্যার জন্য দায়ী মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের বিচার চাইছে। কারণ, মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরে এ বলয়ের বাইরে রয়েছে। তাই রোহিঙ্গা সংকটে এ বলয়ের ভূমিকা ইতিবাচক।

অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন প্রত্যক্ষভাবেই রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। কারণ, চীন মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। এই বাণিজ্যিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে বহু বছর ধরেই চীন মিয়ানমারের শাসন ব্যবস্থাসহ সামরিক কর্মকাণ্ডও নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে রাশিয়া মিয়ানমারের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী।

চীন ও রাশিয়া ছাড়া মিয়ানমার কিছুটা হলেও অনুকূল সুবিধা পাচ্ছে জাপান ও ভারতের কাছ থেকেও। বিশেষ করে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে জাপান কিংবা ভারত কেউই মিয়ানমারের জন্য জোরালো চাপ সৃষ্টির মতো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকছে।

বিশ্নেষকদের বক্তব্য: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতি বিশ্নেষক হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে বাংলাদেশের কূটনীতি সঠিক পথেই আছে। তবে এ তৎপরতা আরও জোরালো হওয়া দরকার। তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে রাশিয়া, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই দুটি দেশ দৃশ্যত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। জাপানও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধু দেশ। কিন্তু জাপানেরও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চোখে পড়ার মতো তৎপরতা দেখায়নি। ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে গভীর সুসম্পর্ক বিদ্যমান। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাই ভারতের কাছে প্রত্যাশা আরও বেশি। এ জায়গাগুলো থেকে আরও কার্যকর তৎপরতার জন্য বাংলাদেশের কূটনীতি জোরালো হওয়া দরকার।’ যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও কানাডা বিভিন্ন সময়ে কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কঠোর পদক্ষেপের বার্তা দিলেও তা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ নানা ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেও এ সংকটের চট করে কোনো সমাধান আশা করা যায় না। কারণ রোহিঙ্গাদের শুধু ফেরত পাঠালেই হবে না; তারা যেন ফিরে গিয়ে নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পারে, সেটাও নিশ্চিত হতে হবে। না হলে এ সংকটের স্থায়ী সমাধান হবে না। তাই এ সংকট নিরসনে জাতিসংঘের আরও কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশিত। এ ছাড়া চীন, রাশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউর কাছ থেকেও আরও কার্যকর পদক্ষেপ আসা দরকার।