বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

0
350

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ ৯ মাস অর্থাৎ ১৯০দিন কারাবাস শেষে পাকিস্তানের কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্তি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী কোটি জনতার প্রিয় সংগঠক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। লাখো বাঙালি উৎসবের আনন্দে এদিন প্রিয় নেতাকে বরণ করে নেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের এক নতুন অভিযাত্রা। সেই থেকে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসছে।
পূর্ব ইতিহাস: পলাশীর আম্রকানন প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার প্রায় দুইশত বছর পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত দুটি রাষ্ট্র নতুনভাবে পথচলা শুরু করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে ‘পূর্ব পকিস্তান’ নামে বাংলাদেশের পথচলা প্রথম থেকেই বাংলার জনগণ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। সালাম, বরকত, রফিক, জুব্বার, উলিউল্লাহর জীবনের বিনীময়ে আমরা ফিরে পাই রাষ্ট্রভাষা বাংলা। পরবর্তীতে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর আইয়ুব খানের মার্শাল ‘ল’ বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির কুখ্যাত হামুদুর রহমান শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু। এরপর তার নেতৃত্বেই ঐতিহাসিক ছয় দফা, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যূত্থান, সত্তুরের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন- এর ফলে বাঙালীরা বাংলার স্বাধীনতার চূড়ান্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ দেখতে শুরু করেছিলেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে পাকিস্তানিরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে যখনই গড়িমসি শুরু করলো, তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানাতে দিক-নির্দেশনামূলক জাতির উদ্দেশে লাখো জনতার সামনে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালো রাতে হঠাৎ করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার বিজয় সূচিত হয়। জন্ম নেয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহনা: ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলার মানুষের ভোটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তাস্তরে গড়িমসি করতে থাকে। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার আড়ালে পাকিস্তানের জান্তা সরকার সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
গ্রেফতার টু পাকিস্তান করাগারে বঙ্গবন্ধু: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার পাকিস্তীিন বাহিনী বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। উদ্দেশ্য সফল করতে পাকিস্তীিন হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির উপর বর্বরোচিত অতর্কিত হামলা চালায়। এতে হাজারো মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার সবজু মাটি। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের ওই অভিযানের শুরুতেই পাকিস্তানী হানাদাররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তাকে স্বাধীনতার দাবি থেকে সরে আসতে বলা হয়। তা না হলে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু বাঙালির অধিকার ছাড়া তিনি কোনো কিছু মানবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। পাকিস্তীিন হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দেন। গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তীিন বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের নির্জন-অন্ধকার কারাগারে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর বিচার। এতে তার ফাঁসির আদেশ হয়। কারাগারের যে সেলে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল, সেই সেলের পাশে কবরও খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতা, মুক্তির প্রশ্নে ফাঁসির আসামি হয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল, আপসহীন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি ও প্রহসনের বিচার বন্ধ করতে প্রবল বিশ্ব জনমতের চাপের মুখে স্বৈরাচার পাকিস্তানী সরকার ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে সাহস পায়নি।
মুজিবনগর সরকার: বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনাসহ দেশের সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। ইতিমধ্যেই জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ. এইচ. এম কামরুজ্জামানসহ নেতবৃন্দকে সেক্টর ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে দায়িত্ব দেয়া দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার বিশ্ব: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও বাঙালি জাতির মনে ছিল না স্বস্তি, বিজয়ের আনন্দ। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জাতির পিতার ভাগ্যে কি আছে এ নিয়ে এ ভূখণ্ডের প্রতিটি মানুষ ছিল বিচলিত, আতঙ্কিত। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বিশ্বনেতারা পাকিস্তানী জান্তার সরকারের বন্দিদশা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
পাকিস্তানের কারাগারে গোপনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সকল প্রকার আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ওই ঘটনার নিন্দা জ্ঞাপন করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের ৬৭টি দেশের সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্র্রধানকে চিঠি দেন। অন্যদিকে তিনি ইউরোপের ৫টি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে বিশ্বজনমত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন। ফলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি।শেষ পর্যন্ত বন্দী দশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে পরাজিত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়।
যেভাবে দেশে এলেন: বাঙালি জাতির মহান এক বিজয়ের ফলেই বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ফিরে আসেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের একটি সামরিক বিমানে অতিগোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওই বিমানে আরও ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তার পরিবার। লন্ডনে সময় তখন ভোর ৮টা ৩০ মিনিট, ৯ জানুয়ারি।
৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি’র ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়- ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’
বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর বিমান থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্জে আসলে তাকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের উপস্থিত কিছু কর্মকর্তা স্বাগত জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন। সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেন ‘গুড মর্নিং মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’
বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙালী ক্যারিজেস হোটেল ঘিরে ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোাগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘এক মুহূর্তের জন্য আামি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি, আমি জানতাম ওরা আমাকে হত্যা করবে, আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবো না, কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে।’
বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ তাঁর বাসভবনে ছুটে আসেন। এসময় বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবনে দেখা করতে গেলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিজে বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। প্রধানমন্ত্রী হিথ তাকে নজীরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ওইদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন।
এই নিয়ে ব্রিটেনে তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু তখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের কোনো পদে অধিষ্ঠিত হননি। ওই সময় তিনি ছিলেন শুধু রাজনৈতিক দলের প্রধান। লন্ডনে একদিন ব্যস্ত সময় কাটানোর পর ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে। বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করে ভারতের দিল্লীতে।
এসময় সব প্রটোকল ভেঙ্গে শীতের সকালে দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করতে গিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। সমগ্র মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানেও তাঁকে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মান দিয়ে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানো হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপে বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় রেখেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী কখন ফেরত আনা হবে। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু যখন চাইবেন তখনই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শেষ সেনা সদস্যকে ফিরিয়ে আনা হবে।
কলকাতার মুখ্যমন্ত্রীও দাবি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু যেন কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে একটু সময়ের জন্য নামেন। যেহেতু স্বাধীন স্বদেশের প্রিয় জনগণ বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে, সেজন্য বঙ্গবন্ধু কলকাতা বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতির প্রতিশ্রুতি দিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর শেষ সেনা সদস্য দল প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা : বঙ্গবন্ধু ঢাকা এসে পৌঁছেন ১০ জানুয়ারি। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। সশ্রদ্ধ চিত্তে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন, সবাইকে দেশগড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২৩ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
১০ জানুয়ারির ভাষণ : বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ১০ জানুয়ারির প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালী ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব স্বীকৃতি দেয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে নির্দেশনা মূলক বক্তব্য দেন।
বঙ্গবন্ধু বিদ্রোহী কবির মতোই অনেকটা আবেগপ্রবণ ছিলেন। ১০ জানুয়ারি তাঁর আবেগনির্ভর হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। তবুও একথা বলতে ভুল করেননি যে, ‘বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। নিজেরাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করুন। যার যার কাজ করে যান।’
ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্টভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ যাদের প্রাণের ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেদিন প্রাণের আবেগমাখা ওই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার শুরুতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সিপাই, পুলিশ, জনগণকে, হিন্দু, মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি আপনাদের কাছে দুই একটা কথা বলতে চাই।’
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ : বাঙালি জাতির মহান মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ৯ মাসের সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়েই বাঙালির বিজয় পূর্ণতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু নিজেই তার এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা’ (অ ঔড়ঁৎহবু ভৎড়স ফধৎশহবংং ঃড় ষরমযঃ) হিসেবে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত বাঙালী নিধনযজ্ঞের নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নে নিরীহ জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালায়।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নটি যখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি- তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বাঙালীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রকৃতপক্ষে ১০ জানুয়ারিতে বাংলার রাজনীতির মুকুটহীন সম্রাট শেখ মুজিবকে পেয়ে বাঙালি বিজয়ের পরিপূর্ণ আনন্দ প্রাণভরে উপভোগ করেছে। এ দিনই বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রবেশ করে গণতন্ত্রের এক আলোকিত অভিযাত্রায়।
জীবন-মৃত্যুর কঠিন চ্যালেঞ্জের ভয়ংকর অধ্যায় পার হয়ে সারা জীবনের স্বপ্ন, সাধনা ও নেতৃত্বের ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তনে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয় পূর্ণতা পায়। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিনটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এসব তথ্য ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে পরিগণিত। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের এসব ঘটনাবলি সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ যেমন জানে তেমনি বিশ্ববাসীও অবহিত রয়েছেন। ১৭ এপ্রিল তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যগণের শপথ গ্রহণ, ১৯৭১ সালের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ, এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস এবং এর পরবর্তি কার্যক্রম জাজ্বল্যমান সত্য। এগুলোর বাইরে কারো কোনো কথা বা ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কোথায় কে কি ব্যক্তিগত মতামত দিচ্ছে, তা ইতিহাসের প্রতিপাদ্য বিষয় হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি গ্রামের কৃতি সন্তান প্রয়াত কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’ যা ১৫ খণ্ডে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাদাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই বাংলাদেশে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সেই ১৫ খণ্ড গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণও হয়েছে।
আমরা আজ স্বদেশ প্রত্যাবর্নতন দিবসে মুক্তিযোদ্ধে শহীদসহ অংশ গ্রহণকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই, স্মরণীয় এই দিনে মহাননেতা বঙ্গবন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু সেদিন আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন যে, ‘তাঁর সারাজীবনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেয়া হবে না।’ আমরা যতদিন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-সংগ্রামের আদর্শে অনুপ্রাণিত থাকবো, ততোদিন আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অটুট থাকবে।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। এদিনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেই শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের দ্রুত দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বন্ধু দেশসমূহ দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
আমরা পরিশেষে বলতে চাই, টেকসই গণতন্ত্র কায়েমসহ কোনো ধরনের অপশক্তি যাতে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ধারাকে ব্যাহত করতে না পারে, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

[এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক]