প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ

0
2331

কামরুল হোসেন মনি:

খুলনার র‌্যাব-৬ ও কোস্ট গার্ড অভিযানের সত্ত্বেও থেমে নেই চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশকারীরা। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ অব্যাহত রয়েছে। রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের ছত্রছায়ায় চলে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ। স্থানীয় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় থাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। অনেক মাছ কোম্পানিও তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপসায় চিংড়ি বণিক সমিতির আওতাধীন ২০০টির মতো চিংড়ির ডিপো রয়েছে। এখানে ৬০-৮০ ডিপোগুলোতে মুনাফা অর্জনের আশায় কতিপয় ব্যবসায়ী জেলি পুশ করছেন চিংড়িতে। স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির ক্যাম্পের টু আইসি ও ওই থানার ওসির সাথে রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এর গভীর সখ্যতা রয়েছে। তাদের ঘর প্রতি মাসিক চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিয়ে পুশ করা হচ্ছে।
রাত হলেই রূপসা থানার ওসি মোঃ রফিকুল ইসলাম ওই চিংড়ি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু আহাদ হাফিজ ওরফে ছোট বাবুর নিজস্ব মাছ ঘরে আড্ডা দিয়ে থাকেন। এছাড়া ওসির সাথে সখ্যতা ও মাসিক মাসোহারা দেওয়ার কারণে চিংড়ি জেলি পুশ হচ্ছে। দিনের তিন সময়ে চিংড়িতে জেলি পুশ করা হয়। এর মধ্যে ১১টা থেকে বিকেল পর্যন্ত, আসর থেকে এশা এবং গভীর রাতে।
জানা গেছে, সিরিঞ্জের মাধ্যমে এই সব জেলি চিংড়িতে পুশ করা হচ্ছে। এর মধ্যে এক মণ বাগদা চিংড়িতে জেলি পুশ করলে ৪ কেজি ওজন বৃদ্ধি পায় এবং গলদা চিংড়িতে পুশ করলে ৬-৭ কেজি ওজন বেড়ে যায়। বর্তমানে বড় সাইজের বাগদা (১২ গ্রেডের) চিংড়ির কেজি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১৫০ টাকা এবং গলদা বড় সাইজের (৫ গ্রেডের) বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬৫০ টাকা। চিংড়িতে জেলি পুশকারীরা ডাক্তার নামে পরিচিতি। ওই সব ডাক্তার চিংড়িতে জেলি পুশ করার জন্য কেজিতে ৮ টাকা করা নিচ্ছেন। আর যদি মাছের ডিপো মালিকরা নিজেরাই জেলি দেন তাহলে তারা (ডাক্তার) পুশ করতে কেজিতে ৫-৬ টাকা নেন। চিংড়িতে যে জেলি ব্যবহার করা হচ্ছে ভারত থেকে আনা হয়। নগরীর বড় বাজার এলাকায় গোপনে লাইন্সেধারীরা এ সব জেলি পুশ চিংড়ি ডিপোগুলোয় বিক্রি করছেন। বর্তমানে এক কেজি জেলি ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। র‌্যাব-৬ ও কোস্ট গার্ডের তৎপরতা থাকায় বর্তমানে ২৫-৩০টি চিংড়ি ডিপোতে স্থানীয় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চিংড়িতে পুশ করা হচ্ছে। সে জন্য রূপসা থানার ওসিকে প্রতিটি অবৈধভাবে জেলি পুশের ঘর থেকে ২ হাজার টাকা ও রূপসা বাসস্ট্যান্ড পুলিশ ফাঁড়ির ক্যাম্প ইনচার্জকে ৫০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে।
রূপসা থানার ওসি মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ সবার সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে। চিংড়ি পুশ দেখভাল করার দায়িত্ব মৎস্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় ইউএনও’র। তারা যদি আমার কাছে পুলিশ ফোর্স চায় আমি দেব। কেউ যদি আমার মাসোহারা নেওয়ার বিষয় প্রমাণ করতে পারে তাহলে চাকরি ছেড়ে দেব।
খুলনা র‌্যাব-৬ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সিপিসি কমান্ডার মোঃ এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, অপরাধ নির্মূল করা যায় না, নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ বিষয়ে জড়িতদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এক গ্রুপ জেলে থাকলে আর এক গ্রুপ মাথাচাড়া দেয়। তিনি বলেন, আমাদের চিংড়ি শিল্পের বিশ্বে সুনাম রয়েছে। এই শিল্পকে বিশ্বে আরও জনপ্রিয় করার জন্য বাংলাদেশের বাইরে রপ্তানিতে আরও বেশি জোরদার হয় সেজন্য আমাদের যে সব করণীয় তা অব্যাহত থাকবে। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
জেলা মৎস্য পরিদর্শক ও মান নিয়ন্ত্রক দপ্তরের উপ-পরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকার বলেন, অবৈধভাবে চিংড়িতে পুশকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকায় এখন চিংড়িতে পুশ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। তাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে তিনিও ছদ্মবেশে বিভিন্ন ডিপোতে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। এছাড়া তাদের নিয়োজিত সোর্সগুলোও তৎপর রয়েছে।
রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সভাপতি আঃ মান্নান বলেন, যারা এই সব অবৈধভাবে চিংড়িতে জেলি পুশ করবে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে উল্লেখ করে বলেন, চিংড়ি পুশের বিষয়ে জনসচেতনতার লক্ষ্যে পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।
রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু আহাদ হাফিজ ওরফে ছোট বাবু অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ধারাবাহিক প্রশাসনের অভিযানের কারণে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ কমেনি দাবি করে তিনি বলেন, তারা চিংড়ি পুশ মাছ কিনছেন না ও মাছ কোম্পানিও পুশকৃত চিংড়ি মাছ কিনছেন না এ কারণেই বতর্মানে চিংড়ি পুশ করা বন্ধ হয়ে গেছে। তার মাছের ডিপোতে অভিযান হয়নি উল্লেখ করে জলিল ফিস ডিপোতে অভিযান পরিচালিত হয়।
রূপসা বাসস্ট্যান্ডের পুলিশ ক্যাম্পের টু আইসি এএসআই মোঃ তরিকুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এই সব বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কেউ বলতে পারবে না, আমি চিংড়ি ডিপো থেকে মাসোহারা নেই।
উল্লেখ্য, চলতি বছরে সেপ্টেম্বর মাসে র‌্যাব-৬ ও মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নতুন বাজারের ৪টি মৎস্য ডিপোতে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় চিংিড়িতে অপদ্রব্য জেলি পুশের অভিযোগে নতুন বাজারের ফাতেমা ফিসের মালিক ফারুক হোসেনকে ৭৫ হাজার টাকা, অপু ফিসের মালিক আকাশ রায়কে ২০ হাজার টাকা, সুমন ফিসের মালিক সুমনকে ৫০ হাজার টাকা এবং আঁখি ফিসের মালিক মো. আলমগীর শেখকে ৫০ হাজার টাকাসহ মোট ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। খুলনা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অংগ্যজাই মারমা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ওই জরিমানা আদায় করেন। এ সময় চারটি ডিপো থেকে জেলি পুশকৃত ৫০ কেজি গলদা ও ৬৫০ কেজি বাগদা চিংড়ি জব্দ করে তা রূপসা নদীতে ফেলে দিয়ে বিনষ্ট করা হয়। এছাড়া পুশের অপেক্ষায় রাখা আরও ১ হাজার কেজি চিংড়ি উদ্ধার করে বিভিন্ন এতিমখানায় বিতরণ করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় রূপসায় চিংড়ি ডিপোতে র‌্যাব-৬ ও স্থানীয় কোস্ট গার্ড অভিযান পরিচালনা করে জেলি পুশকৃত চিংড়ি উদ্ধার করেন।