পিটিয়ে হত্যার পেছনে সরকারবিরোধী রাজনীতি: আইজিপি

0
354

খুলনাটাইমস পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে ‘সরকারবিরোধী রাজনীতির’ যোগাযোগ পেয়েছেন তারা। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে এ ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, সকল আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এই সহজ পথটি, অর্থাৎ ফেসবুকে বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব ছড়ানোকে বেছে নিয়েছে। গুজব প্রতিরোধে পুলিশের কর্মসূচি নিয়ে গতকাল বুধবার সকালে পুলিশ সদরদপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীর এ মন্তব্য আসে। সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যে কজনকে গ্রেফতার করেছি, তাদের কয়েকজনের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে সরকারবিরোধী রাজনীতি করার লিংক আমরা খুঁজে পাচ্ছি। তবে গ্রেফতারদের মধ্যে সরকার পক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি বলে আরেক প্রশ্নের উত্তরে বলেন তিনি। পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে ‘মানুষের মাথা লাগবে’ বলে সম্প্রতি ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয়, যাতে বিভ্রান্ত না হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল সরকার। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়। এরমধ্যে গত বৃহস্পতিবার নেত্রকোণা শহরে এক যুবকের ব্যাগ তল্লাশি করে ‘শিশুর মাথা’ পাওয়ার পর তাকে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। তারপরও দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির ঘটনা ঘটে চলছে প্রতিদিন। ঢাকার বাড্ডায় সন্তানকে ভর্তির জন্য স্কুলের তথ্য নিতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনিতে প্রাণ গেছে এক নারীর। পুরনো শত্রুতার জেরে মিথ্যা অভিযোগ তুলে জনতাকে লেলিয়ে দিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে গুজব রটিয়ে মোট ৬ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর গতকাল বুধবার পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, পিটিয়ে যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ অপহরণকারী বা ‘ছেলেধরা’ ছিলেন না। গুজব ছড়ানো হয়েছে ভিন্ন উদ্দেশ্য থেকে। স্বার্থান্বেষী মহল সুপরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে (বিস্তারিত) কিছু বলছি না, শুধু দেশে না, দেশের বাইরে থেকেও এ ধরনের প্রপাগান্ডা এবং (ফেসবুক) পোস্ট এসেছে। আইজিপি বলেন, প্রথম যে ফেসবুক পোস্টটি পুলিশের নজরে এসেছে, সেটার মূল খুঁজতে গিয়ে তারা ‘দুবাইভিত্তিক একজনের’ সম্পৃক্ততা পেয়েছেন। এ ধরনের কোনো ঘটনা দেখলে পুলিশকে জানাতে অনুরোধ করেন আইজিপি। তিনি বলেন, যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে তারা হত্যা মামলার আসামি হবে। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে এ পর্যন্ত ৬০টি ফেইসবুক আইডি, ২৫টি ইউটিউব চ্যানেল ও দশটি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে তথ্য দেন বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান। এছাড়া গুজব রটনা ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ৩১টি মামলা হয়েছে, এসব মামলায় ১০৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আইজিপি বলেন, আমাদের উপর আস্থা রাখুন। সঠিক বিষয়গুলি বের করব। এ বিষয়ে পুলিশের উদ্যোগের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার থেকে সারা দেশে ‘গুজব বিরোধী সচেতনতা সপ্তাহ’ পালন করা হবে জানিয়ে জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবাতেও এসব বিষয়ে বয়ান করা হবে। আইজিপি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে গত কয়েকদিনে আটজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দেশজুড়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির প্রত্যেকটি ঘটনা আমরা বিশ্লেষণ করেছি। কোনো ঘটনাতেই ধৃত আহত ব্যক্তি কিংবা মৃত ব্যক্তিদের কেউই অপহরণকারী ছিলেন না। গত ১৮ জুলাই নেত্রকোণায় রবিন নামে এক ব্যক্তির কাছে সজীব নামের এক ছেলের কাটা মাথা পাওয়া যায়। পরে গণপিটুনিতে রবিন নিহত হয়েছেন। মাদকাসক্ত রবিন তার স্ত্রীকেও একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করেছিলেন, এ কারণে তার স্ত্রী চলে গেছে। নিহত শিশু সজীবের লাশ ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, তাকে বলৎকার করা হয়েছিল। পারিপার্শ্বিক সব ঘটনা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বলৎকার করার সময় প্রতিরোধ বা জানাজানির ভয়ে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সজীবকে খুন করা হয়েছিল। সাভারে এবং নারায়ণগঞ্জে দুইজন বুদ্ধি ও বাক প্রতিবন্ধীকে পিটিয়ে মারা হলো। বাড্ডায় এক মাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। আইজিপি বলেন, আমি দেশবাসীকে স্পষ্ট করে বলতে চাই, এটি গুজব এবং ¯্রফে গুজব। কোনো ঘটনাতে ছেলেধরার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার থেকে দেশজুড়ে সচেতনতা সপ্তাহ পালন করা হবে। সপ্তাহজুড়ে পুলিশের প্রতিটি সদস্য সব স্টেক হোল্ডারদের কাছে যাবেন। প্রশিক্ষিত সদস্যরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলবেন। গুজব ছড়ানোর বিষয়টি পুলিশের নজরে আসার পর থেকেই বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে মাঠপর্যায়ে প্রতিটি ইউনিটকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করছি, যেকোনো পরিস্থিতিতে যেন পুলিশের সহায়তা নেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য মোতায়েনের চেষ্টা করছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাইকিং করা হচ্ছে, লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। আগামি শুক্রবার জুমার নামাজের আগে খুতবায় এ বিষয়ে বয়ান দিতে মসজিদের ঈমামদের অনুরোধ করে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইজিপি বলেন, চাঁদে মানুষ পৌঁছানোর ৫০ বছর হয়ে গেলো। কিন্তু সাঈদীকে চাঁদে দেখা যায় এটা বিশ্বাস করতে এমন লোকের অভাব হয় না। আমাদের দেশের মানুষ অত্যন্ত সহজ-সরল, তাদেরকে সহজেই বিভ্রান্ত করা যায়। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে একজন নিরাপরাধ মানুষও যেন হয়রানীর শিকার না হয়, গ্রেফতার না হয় সে বিষয়ে পুলিশ সচেতন রয়েছে বলেও জানান তিনি। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আইজিপি বলেন, গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আপনি নিজেও জানেন না, গণপিটুনিতে অংশ নিয়ে আপনি হত্যা মামলার আসামি হয়ে যাচ্ছেন। যে অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে। কেউ যদি এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করা হলে, সেই ব্যক্তি যেই হোন আর যেখানেই থাকেন তাকে খুঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। দিনের আলোতে চোখের সামনে হাজারও দেশি-বিদেশি মানুষের চেষ্টায় পদ্মাসেতু বানানো হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত কোনো গুজবে কান না দিয়ে পদ্মাসেতু এলাকা ঘুরে আসতে শিশুদের আহ্বান জানান আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। একইসঙ্গে এ বিষয়ে কেউ ভয় দেখানোর চেষ্টা করলে, ভয় না পেয়ে ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশকে জানানোর অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। আইজিপি বলেন, পদ্মাসেতু দেশের অন্যতম বৃহৎ স্থাপনা। যা দেশি-বিদেশি হাজারও শ্রমিক-কর্মী দিনের আলোতে নির্মাণ করছেন। ইতোমধ্যে এই সেতুর সার্বিকভাবে ৭২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। যে কেউ তাদের কাজগুলো দেখে আসতে পারে, ঘুরে আসতে পারে। শিশুদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তোমাদের বাড়িগুলো যেমন ইট, বালু ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়, একইভাবে পদ্মাসেতুও ইট-সিমেন্ট দিয়ে বানানো হচ্ছে। তোমরা যেকোনো সময় গিয়ে পদ্মাসেতু এলাকা ঘুরে দেখে আসতে পারো। চোখের সামনেইতো ঢাকা-চট্টগ্রামে অনেকগুলো ফ্লাইওভার হলো। যমুনা নদীতে এখন পর্যন্ত সর্ববৃহৎ সেতু নির্মাণ হলো। পদ্মাসেতু নিয়ে কেউ তোমাদের কোনো বাজে কথা বললে বা ভয় দেখালে, তোমরা ভয় পাবে না। কেউ এ ধরনের কথা বললে যে কারও মোবাইল থেকে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে আমাদের জানাবে। তিনি এও বলেন, আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের নিরাপত্তায় পুলিশ সর্বশক্তি দিয়ে আপনাদের পাশে থাকবে। গণপিটুনির কোনো ঘটনা ঘটলে আপনারা তাতে অংশ না নিয়ে পুলিশকে জানান। পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে।