পত্রমিতালী করে বন্ধু আর জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছিলেন যারা

0
558

অনলাইন ডেস্ক : পারিবারে ও বন্ধুমহলে তাদেরকে ‘সবুজ-সাথী জুটি’ বলা হয়। বিয়ের আগেই তাদের বন্ধুত্বের শুরু হয়েছিল, পত্রমিতালীর মাধ্যমে। আজকের দিনে যা প্রায় অচেনা একটা ব্যবস্থা। কিন্তু নব্বই এর দশক পর্যন্ত পুরো বিশ্বের মত বাংলাদেশেও যা ছিল নতুন বন্ধুত্ব করার এক মাধ্যম। ১৯৯৪ সালে কিশোরগঞ্জের মেয়ে উম্মে সালমা সাথী দৈনিক পত্রিকায় পত্রমিতালীর বিজ্ঞাপন দেখে চিঠি লিখেছিলেন খুলনার রফিকুল ইসলাম সবুজের কাছে। খবর বিবিসির।
‘পেপার পড়তাম, সেইখানে পত্রমিতালীর বিজ্ঞাপন থাকত, তো বান্ধবীকে বলেছিলাম এসএসসিতে ফার্স্ট ডিভিশন পেলে পত্রমিতালী করবো। সেই মত ভোরের কাগজ পেপারে ঠিকানা দেখে আমি চিঠি লিখেছিলাম। দূর দেখে লিখেছিলাম, আমি ভৈরবের মেয়ে, আর ওর বাড়ি খুলনায়, যেন জীবনেও আসতে না পারে! তাহলে বাড়ির কেউ জানতে পারবে না।’
২৫ দিন পর চিঠির জবাব এসেছিল সাথীর কাছে। এদিকে, ইসলাম যখন বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তিনি ভেবে রেখেছিলেন প্রথম যার কাছ থেকে চিঠি আসবে, সেই হবে তার পত্রমিতা, ছেলে বা মেয়ে যেই লিখুক।

বন্ধু হয়েছিলেন তারা, এরপর ক্রমে বন্ধুত্ব থেকে প্রণয় এবং পরিণয়। ‘আমি দুষ্টামীর ছলে বন্ধুদের সাথে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম, আমি তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। চিঠি পেয়ে জবাব দেই। এরপর শুরু। এর আড়াই বছর পর আমি ভৈরব গিয়ে দেখা করি। তারো এক বছর পরে আমরা পরস্পরকে ভালোবাসার কথা বলি।’
প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল? সাথী জানাচ্ছেন, ‘এত বছর ধরে চেনাজানা একজনকে মানা কীভাবে করবো? কষ্ট পাবে না? সেজন্য ‘হ্যা’ করে দিয়েছিলাম।’ ‘ভাবি নাই বিয়ে হবে এতদূরে! কিন্তু এর দেড় বছর পরে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের বিশ বছর চলছে আমাদের।’ হাসতে হাসতে জানান সাথী।
‘সবুজ-সাথী জুটি’ জানিয়েছেন, একেকটি চিঠি আসার মাঝখানে যে সময়ের দূরত্ব থাকে, তার উত্তেজনা ছিল অপরিসীম, তার সঙ্গে এখনকার সামাজিক মাধ্যমে হওয়া বন্ধুত্বের কোন তুলনাই হয় না।

বন্ধুত্বের প্রত্যাশায় বিজ্ঞাপন
১৯৮০ ও ৯০ এর দশকে বাংলাদেশের প্রায় সব দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই বন্ধুত্বের প্রত্যাশায় নাম ও ঠিকানা দিয়ে ছোট ছোট বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। সব পত্রমিতাই প্রণয় ও পরিণয়ে গড়াতো না, কেউ কেউ হয়তো রয়ে গেছেন অদেখা-অজানাই।
কিন্তু সেই সময়ের বিজ্ঞাপনের একটি বড় অংশই থাকতো এ ধরণের বিজ্ঞাপন, বিশেষ করে ম্যাগাজিনগুলোতে। ‘দৈনিক পত্রিকায় একটু কমই হোত, কিন্তু ম্যাগাজিনগুলোতে বেশি থাকতো। কখনো আধা পৃষ্ঠা পুরোই বিজ্ঞাপন থাকতো। সেসময় সন্ধানী বা বিচিত্রার মত নামী ম্যাগাজিন ছিল, তাতেও থাকতো।’
একটা ট্যাবলয়েড ছিল, তাতে প্রচুর এ ধরণের বিজ্ঞাপন থাকতো। বিশেষত ছাত্রছাত্রীরাই এমন বিজ্ঞাপন দিতে আসতো বেশি।

কেমন ছিল সেই সময়
পত্রমিতালী নিয়ে পুরো বিশ্বেই নানা ধরনের গল্প আছে। লেখক অদিতি ফাল্গুনী মনে করেন, অদেখা অজানার প্রতি আগ্রহ থেকেই মানুষ বন্ধুত্বের সন্ধান করতো প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নতি সাধনের আগ পর্যন্ত। তার কাছে এটা মূলত তরুণরাই করত, কিন্তু অন্য বয়সের মানুষও ছিল।

আমরা যে সময়টাতে বড় হয়েছি আমাদের চারপাশে এমন প্রচুর ঘটনা দেখেছি। বড় ভাইবোন তাদের বন্ধুবান্ধব অনেকেরই পত্রমিতা ছিল। অজানা অদেখা যে সে চিরসুন্দর, চির রহস্যময়। তার টান একটা ব্যপার। তবে, সেসময় চিঠি লিখতে লিখতে ছেলেমেয়েরা দুটি উদ্ধৃতি দিত, তিনটা কবিতা পড়তো, হাতের লেখা সন্দুর করার একটা চেষ্টা থাকতো।’
পত্রমিতালীর মত এই বন্ধুত্বের বাহন ছিল ডাক বিভাগ। জেলা থেকে জেলায়, কখনো ভিন দেশেও বন্ধুত্বের বার্তা নিয়ে যেত ডাক হকাররা। প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষকে এগিয়ে দিয়েছে এক দ্রুতগামী জীবনে, যেখানে হৃদয়ের উষ্ণ আবেগ নিয়ে আসা একেকটি চিঠি এখন কেবলই এক নস্টালজিয়া।