নানা কারণে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে মাদক মামলার অর্ধেকের বেশি আসামি

0
469

খুলনাটাইমস এক্সক্লুসিভ: দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই মাদক বিরোধী অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব অভিযানে হাজার হাজার মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী আটক হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় দায়ের করা হচ্ছে মামলা। শুধু সমসাময়িক এসব ঘটনাই নয়, অন্যান্য সময়ে দায়েরকৃত বেশিরভাগ মাদক মামলাতেও নানা ধরণের ত্রæটির কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ১০ বছরে সারা দেশে ডিএনসি’র দায়েরকৃত ২৬ হাজারের বেশি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ মামলাই প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে এসব মামলার ১৪ হাজার ৬৬৫ জন আসামি খালাস পান, যা মোট আসামির ৫১ শতাংশ। অর্থাৎ গত দশ বছরে মাদক মামলার অর্ধেকের বেশি আসামি ছাড়া পেয়ে গেছেন।
গত এক দশকে নিষ্পন্ন হওয়া মামলা পর্যালোচনা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আসামিদের খালাস পাওয়ার পেছনে আটটি কারণ চিহ্নিত করেছে বলে জানা গেছে। এগুলো হলো, ত্রæটিপূর্ণ এজাহার, বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থতা, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া, আইনের বিধান অনুযায়ী জব্দ তালিকা তৈরি না করা, জব্দ তালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল, বাদী ও অভিযানকারী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অমিল, আদালতে সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তাও সাক্ষ্য দিতে আসেন না।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলায় আসামির সাজা হওয়ার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ। সাক্ষী না থাকলে অপরাধ প্রমাণ করা যায় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আদালতে সাক্ষী হাজিরে বাধ্য করতে হবে। তিনি ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি হলে সাক্ষী না আসায় মামলা বিলম্বিত হবে না। এছাড়া অনেকক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে সাক্ষী হাজির করা হয় না। এতে মামলা শেষ হয় না। দেরি হয়ে গেলে তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হয়ে যান; সাক্ষী পাওয়া যায় না। এ কারণে আসামি খালাস পেয়ে যায়।
এদিকে ডিএনসির আটটি কারণ ছাড়াও মাদক মামলার আসামি খালাস হয়ে যাওয়ার পেছনে আইন সংশ্লিষ্টরা আরও দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো, সরকারি কৌঁসুলিদের অস্থায়ী ভিত্তিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ করা হয়, তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা আমলে নেওয়া হয় না। এবং সরকারের দায়িত্ব সাক্ষী ও আলামত হাজির করা, কিন্তু এখানে ব্যর্থতা আছে। আর ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতার কারণে অপরাধী খালাস পেয়ে যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মামলার ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই বাদী, নিজেরাই তদন্ত কর্মকর্তা। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমন ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়। এজাহারে সাক্ষীর সঠিক নাম-ঠিকানা থাকে না।
সংশ্লিষ্টররা বলছেন, ত্রæটির কারণে মাদক মামলার আসামিরা যাতে বেরিয়ে আসতে না পারে সেজন্য বিষয়গুলো আন্তরিকতার সঙ্গে কর্তৃপক্ষের দেখা দরকার। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ওপর নজরদারি রাখাও প্রয়োজন। মামলার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এজাহারকে ত্রæটিমুক্ত করতে হবে। মামলার তদন্ত ও জব্দ তালিকা যথাযথভাবে করতে হবে। মতলবি তদন্ত চলবে না। নিরপেক্ষ সাক্ষী থাকা জরুরি। জব্দ করা দ্রব্য যে মাদক- সেটা প্রমাণ করতে হবে। এসব না থাকলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়। আসামিপক্ষকে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। ন্যূনতম সন্দেহ থাকলে আসামি খালাস হয়ে যায়। এছাড়া, মাদকের সঙ্গে রাঘববোয়ালরা জড়িত। অনেক ক্ষেত্রে তারা মামলায় প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণে এজাহার ও চার্জশিট ঠিকমতো হয় না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মাদক মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে আবার একই পেশায় ফিরছেন। মামলায় সফলতা অর্জনের মৌলিক প্রশিক্ষণ নেই তদন্তকারীদের। এই অবস্থায় সারা দেশে এখন যে হাজার হজার হাজার মামলা তদন্তাধীন আছে, সেগুলোর কতটা শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হবে, তা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সচেতন মহলের মতে, অপরাধ কমাতে ও সমাজকে মাদকমুক্ত করতে মাদক মামলার আসামিদের সাজা নিশ্চিত করতেই হবে।