খুলনায় কিশোর গ্যাং ফের সক্রিয়

0
820

সাইমুম মোর্শেদঃ খুলনায় কিশোর গ্যাংগুলো ফের পুরোদমে সক্রিয়। এই গ্যাং এখন রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বেপরোয়া কাণ্ডে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। চায়ের দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়ক এমনকি বিভিন্ন আবাসিক এলাকার আশপাশে কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক দলের সদস্য ঘোরাঘুরি করে। চায়ের দোকানগুলোয় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আড্ডায় মেতে থাকে। আর স্কুল-কলেজের ছুটির সময়ও এদের উৎপাতে অস্থির হয়ে ওঠেন সেখানে আগত অভিভাবকরা।পাশাপাশি রাস্তাঘাট এমনকি আবাসিকের নিরিবিলি পরিবেশকে তারা মুহূর্তে অশান্ত করে তোলে। এমনই নানা অভিযোগ স্থানীয়দের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার এক নগরিক প্রতিবেদককে বলেন, এই ছেলেগুলো প্রতিদিন গ্রুপে গ্রুপে লেকপার্কে আসে।ঘণ্টার পর ঘণ্টা  বসে থাকে।ছোট্ট বাচ্চা।বয়স মনে হয় ১৫-১৬ বছর হবে। আর এরাই একটার পর একটা সিগারেট টানে।কোনো মুরব্বিও মানে না।যতক্ষণ থাকে তাদের দখলে চলে যায় দোকানটা।তিন-চারজন হলে একটা কথা।একসঙ্গে আট-দশজন আসে। তিনি আরো জানান, কিশোরদের এই গ্রুপগুলো মুজগুন্নি, বয়রা ,বাস্তহারার, সোনাডাঙ্গা, গল্লামাড়ী বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়।একেক জায়গায় একেক গ্রুপ বসে থাকে।বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন করে আসে। চায়ের দোকানে ভিড় করে হইহুল্লোড় করেই ক্ষান্ত হয় না কিশোর গ্যাংয়ের ওই দলগুলো।এরা নিয়মিত চলন্ত রিক্সা ও ইউজ বাইকে  মটরবাইকের মাধ্যমে ছিনতাই করে থাকে।ইদানিং এই ছিনতাই বা টানবাজদের সংখ্যা বেড়েই চলছে।এতে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ।এছারাও এই কিশোরেরা সোনাডাঙ্গা লেক পার্ক, বাস্তহারা ছাতিপার্ক এর মত উন্মুক্ত পার্কে বেড়াতে আসা সাধারণ মানুষদেরও উত্ত্যক্ত করে। বিশেষ করে কোনো প্রেমিক যুগলকে একসঙ্গে বসে গল্প করতে দেখলে নানাভাবে বিরক্ত করে। এতে কেউ ক্ষিপ্ত হলে তার ওপর চড়াও হয়।

সরজমিন মঙ্গলবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, একদল কিশোর যাদের বয়স ১৬-১৭ বছর। কারো পরনে কলেজের ইউনিফর্ম।আবার কেউ সাধারণ পোশাকে।বাস্তহারা সিটি লিংক রোডের থেকে একটু এগিয়ে দেখা মেলে তাদের। ৪টি মোটরসাইকেলে করে আটজন এসেছে। স্কুল-কলেজের পোশাক পরিহিত হলেও তাদের কারো কাঁধে ব্যাগ ছিল না।এদের মধ্যে একজন হুসেন নাম ধরে আরেকজনকে ডাক দিতে শোনা যায়।একে অপরকে বলছিল ‘নেক্সট মিশন’ কি হবে? কিন্তু কি মিশন নিয়ে কথা বলছিল সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না।পার্শ্ববর্তী এক ঝালমুড়ি ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে জানা গেল এদের সবার ফেসবুকে একটা গ্রুপ আছে। কেউ এইট্টিন প্লাস বয়েজ আর কেউ ডিস্কো বয়েজ নামে পরিচিত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই লোক জানান, প্রায়ই তারা এলাকার দোকানে এসে অড্ডা দেয় কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তবে একাধিক গ্রুপ একসঙ্গে আসে না। তাদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে কেউ কারো সামনে আসে না। তিনি বলেন, এদের মধ্যে মারামারির ঘটনা হয়। মাঝে মাঝে এই রাস্তার উপরই মারামারি শুরু করে। মারামারির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কি নিয়ে মারামারি হয় সেটা তাদের আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। তবে একই এলাকায় ‘সিনিয়র-জুনিয়র’ হওয়া নিয়ে মারামারি বাঁধে।কয়েকবারই দোকানের সামনে এসে মারামারি করেছে।মাঝে মাঝে তাদের এসব কাণ্ড দেখে ভয়ে অনেকে এখানে বসতে চান না।গত মঙ্গলবার (২৪ জুলাই) রাত আনুমানিক ৯টার দিকে বয়রার এক নাম্বার আবাসিকের রোডে এই কিশোর গ্রুপের সদস্যদের অন্য গ্রুপকে ধাওয়া দিতে বয়রা বাজারের দিকে নিয়ে যেতে দেখা যায়, এ সময় জনমনের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করে।পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

এদিকে কিশোর গ্যাংগুলোর আতঙ্কে বয়রার আবাসিকের সাধারণ জনগনও।নগরীর মুজগুন্নি আবাসিকের ১৭ নং রোডের পরে মুজগুন্নি পার্ক পর্যন্ত অনেকটাই ফাঁকা থাকে প্রায় সময়।এই জায়গাগুলোতে সন্ধ্যার পর আড্ডা জমায় ১০-১২ জনের মতো কিশোর।মাঝে মাঝে তারা এলাকার মধ্যে হট্টগোল বাধিয়ে দেয়।আশপাশের চলাচলকারী অনেকেই তাদের ঝামেলার কারণে পথ চলতে অসুবিধায় পড়েন। বেশির ভাগ সময় এদের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের মধ্যে মারামারি করে।একপর্যায়ে কেউ কেউ মারাত্মকভাবে জখম হতেও দেখা যায়।আর এ সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এলাকাবাসী।অত্র এলাকায় বসবাসকারী তরিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি জানান, এই ছোট ছোট ছেলেগুলো সন্ধ্যার পর আড্ডা জমায়।পড়ালেখার কোনো খবর নেই।দিনের বেলায় স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা আর রাতে আড্ডা দেয়া তাদের কাজ।মাঝে মাঝে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে।তখনই ভয় হয়। শুনেছি এরা এখন আরো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে।

মুজগুন্নি আবাসিকের ইসলামবাগ রোডের বাসিন্দা মোঃ আজাদ বলেন, কয় একদিন আগে ১৭,১৮ বছর বয়সি একটি ছেলে আমার বাসার নিচতলা ও দুইতলার সিসিটিভি ভেঙ্গে নিয়ে যায়, ভিডিও তে ছেলেটিকে দেখে কিশোর মনে হলো, তার মাথায় ক্যাপ ও মুখে রুমাল দিয়ে পেচানো ছিলো।তবে কি কারনে বা কেনো এই সিসিটিভি চুরি করা হয়েছে তা বুঝতে পারলাম না।

গত ২০ জানুয়ারি খুলনা পাবলিক কলেজে কনসার্ট চলাকালে সমবয়সী বন্ধুদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ফাহমিদ তানভির রাজিন নিহত হয়। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর রাতে বন্ধুদের হাতে খুন হয় রূপসা হাইস্কুলের ১০ম শ্রেণির ছাত্র সিয়াম। এছাড়া মহানগরীর আরও বেশ কয়েকটি স্কুলে বখাটে যুবকদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। এ সব কিশোরদের দিয়েই এখন এলাকায় অধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চলছে।

২০ জানুয়ারি রাজিন হত্যার পর গ্রেফতার হয় সাব্বির, রিফাত ও রিজভি। এদের মধ্যে রিফাত ও রিজভি ‘ডেঞ্জার বয়েজ’ গ্রুপের সদস্য। আর সাব্বির ‘গোল্ডেন বয়েজ’ গ্রুপের। এখনও পলাতক থাকা ফাহিমও ‘গোল্ডেন বয়েজ’ গ্রুপের অন্যতম সদস্য। হত্যাকাণ্ডের পর র‌্যাবের হাতে আটক হয়ে রয়েল ও মিতুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ সব তথ্য জানায়। পরে র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে অন্যরা।

আবাসিক এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের এই উৎপাত প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোঃ মনোয়ার হোসেন জানান, এই বয়সটাতে ছেলেরা এসবই করে বেড়ায়। এটা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি। তবে এখানে অভিভাবকরা যদি তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে যত্ন না করেন তাহলে আরো আক্রমাণত্মক হয়ে উঠবে ওরা। সন্তানদের প্রচুর ভালোবাসতে হবে। তাদের খোঁজ খবর নিতে হবে। আমিও একজন বাবা। আমার দুটি ছেলে রয়েছে। তাদের প্রতিদিন বাসায় গিয়ে বন্ধুসুলভ আচরণ করি। তারা অপেক্ষা করে বাবা কখন আসবে আর কখন একসাথে সবাই মিলে রাতের খাবার খাবো। এই বন্ধনটা প্রত্যেক বাবা-মায়ের সন্তানের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে। আসলে এটাই বড় অভাব। যে কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। তবে আমরা যারা আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে রয়েছি,আমাদের সবার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।প্রতিটি স্কুল-কলেজ ক্যাম্পাস ও শপিং মলগুলোর সামনে পুলিশের টহল বারানো উচিত।

সম্প্রতি আড়ংঘাটা থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী রেজাউল করিম রেজা খুলনা টাইমসের এক প্রতিবেদনে বখাটের উদেশ্য করে জিরো টলারেন্স ঘোষনা দিয়ে বলেন, বখাটে ছেলেদের প্রতি জিরোটলারেস ঘোষনা করা হয়েছে। বখাটে ছেলেদের কে থানায় ধরে নিয়ে আসলে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দলের  নেতাদের অনুরোধে ছেড়ে দিতে হয়। আমি যতো দিন এই থানার দায়িত্বে থাকবো, বখাটেদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবো। তিনি স্কুলের শিক্ষক,অভিভাবকসহ সমাজের সচেতন মহলের নিকট সাহায্য সহযোগীতা চেয়েছেন।

ওসি রেজাউল আরো বলেন, স্কুলের সামনে সাদা পোশাকে এবং পোশাক ধারি পুলিশের নজর দারি বাড়ানো হয়ছে। স্কুল চলাকালিন সময় স্কুলের সামনে বা বাজারের চা দোকানে, সেলুন, হোটেল গুলোতে কোন বখাটে ছেলেকে বসতে দেওয়া হবে না এবং সন্ধ্যার পরে কোন যুবক কে মোড়ে আড্ডা বাজি করতে দেওয়া হবে না।  থানা এলাকার প্রতিটি বাজার কমিটির নেতাদের কে এ বিষয় বলা হয়েছে। কোন দোকানদার বখাটেদের কে বসার সুজোগ করে দিলে, দোকানদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্তা গ্রহন করা হবে।