খুলনায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ধর্ষণ

0
850

এম জে ফরাজী : খুলনায় সব অপরাধকে ছাপিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ‘ধর্ষণ’। শহরের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়েছেন নগরবাসী। এতে করে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে সাধারণ শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। আর উদ্বেগজনক হারে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
খুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে রেলওয়ে থানায় নারীকে ওসি’র নেতৃত্বে গণধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে সমালোচিত হয়েছে। গত ২ আগস্ট যশোর থেকে ট্রেনে খুলনায় আসার পথে এক নারীকে (৩০) আটক করে খুলনার জিআরপি থানা পুলিশ। ওই রাতেই থানার হাজতে ওসি উছমান গণি পাঠানসহ ৫ পুলিশ সদস্য তাকে মারধর ও ধর্ষণ করেন। গত ৪ আগস্ট ওই নারী খুলনার অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুজ্জামানের আদালতে মারধর ও গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। আদালত তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন এবং তার ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় ওসিসহ ৫ জনের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে ঘটনাটি দুটি কমিটি তদন্ত করছে।
এরপর আলোচনায় আসে কর কমিশনার প্রশান্ত কুমার রায়ের ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ। খুলনা নর্থ ওয়েস্টার্ণ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শিঞ্জন রায় তার সহপাঠীর সাথে একবছর ধরে প্রেমের পর বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় ওই ছাত্রী অন্তঃসত্তা হয়ে পড়েন। কিন্তু তাকে না জানিয়ে শিঞ্জন গত ১৪ আগস্ট অন্যত্র বিয়ে করেন। বিয়ের খবর ওই ছাত্রীর কাছে পৌঁছালে তিনি শিঞ্জনের খোঁজে গত ১৫ আগস্ট রাতে মুজগুন্নী আবাসিকে যান। শিঞ্জন তাকে সেখান থেকে ইজিবাইকে জোর করে তুলে দিতে গেলে স্থানীয়দের নজরে আসে। থানা পুলিশের কাছে খবর গেলে তারা দু’জনকেই সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় নিয়ে আসে। পরে ওই ছাত্রী ১৬ আগস্ট নিজেই বাদী হয়ে শিঞ্জন রায়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে রিমাণ্ড শেষে আসামী কারাগারে রয়েছে।
একইদিন ১৬ আগস্ট শুক্রবার খুলনা মহানগরীর টুটপাড়া মহিরবাড়ি খালপাড় এলাকায় সাত বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শিশুটি অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে নিজ বাড়ি থেকে বের হয়। এসময় এক যুবক ফুঁসলিয়ে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি নির্জন বাড়ির সিঁড়ির নিচে নিয়ে ধর্ষণ করে। রক্তাক্ত অবস্থায় শিশুটি পরিবারের সদস্যদের ঘটনাটি জানায়। এলাকাবাসীর সহায়তায় তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ১০ দিন অতিবাহিত হলেও এ ঘটনায় ধর্ষককে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
গত ২৩ আগস্ট রাত ৯টায় নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন করিমনগর এলাকার রওশন আরা ক্লিনিকের পিছনে স্বামী পরিত্যক্তা এক নারীকে প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে পটিয়ে বাড়ির ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে সৌরভ ওই নারীকে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় শনিবার রাতে ভুক্তভোগী নারী বাদী থানায় একটি ধর্ষণ মামলা করেন। যার মামলা নং ৩০। এই ঘটনায় ধর্ষক সৌরভসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এরই মধ্যে গত রবিবার (২৬ আগস্ট) নগরীর শেখপাড়া লোহাপট্টি এলাকায় ১০ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে তার খালাতো ভাই। রবিবার দুুপুর ১২টার সময় এ ঘটনা ঘটলেও রাত সাড়ে ১০টায় সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশ মেয়েটিকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। অভিযুক্ত আশিক (২০) একই এলাকার মজিদ খান এর ছেলে। ঘটনার পর থেকে সে পলাতক থাকলেও সোমবার তাকে গ্রেফতার করা হয়।
এর আগে গত ৩ জুলাই খুবির চারুকলা অনুষদে চিত্রকলা প্রদর্শনীর রাতে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে চারুকলার লাইব্রেরিতে নিয়ে পরিচিত ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পাপ্পু কুমার মণ্ডল। পাপ্পু সেই ছাত্রীটিকে পড়াতেন। ঘটনার পর গত ১৫ জুলাই পাপ্পু বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা তার মুখে কালি লাগিয়ে ও গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেন। পরে গত ৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হয়।
এ ঘটনার তিন দিন আগে ২৯ জুন (শনিবার) বিকেলে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে পল্লীমঙ্গল স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীকে ফুসলিয়ে নিয়ে প্রেমিক শান্তসহ নয়জন পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে মেয়েটির কান্নাকাটিতে আশেপাশের লোকজন পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে। এ গণধর্ষণের ঘটনায় ৩০ জুন (রবিবার) ওই কিশোরীর বোন বাদী হয়ে ৯ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত দুই-তিনজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনা স্বীকার করে ইতোমধ্যে তিন আসামী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ বিষয়ে মহিলা পরিষদের নেত্রী ইশরাত আরা হিরা বলেন, ‘খুলনায় ধর্ষণ মহামারী আকারে ধারণ করছে। আগে কম হলেও চলতি আগস্ট মাসে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এতে শিক্ষার্থীদের সাথে অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন। ধর্ষণের বিষয়ে এখনই সোচ্চার হতে হবে। সবাইকে সচেতন করতে পারলেই ধর্ষণ কমিয়ে আনা যাবে।’
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা-খুলনা জেলার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পারিবারিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। স্কুল-কলেজে ধর্ষণের বিষয়ে কাউন্সিলিং করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এজন্য চাঞ্চল্যকর এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। আর পুলিশ প্রশাসনকে এসব বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। তবেই ধর্ষণে কমে আসবে।’
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) এর এডিসি (সদর ও মিডিয়া) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আসামীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিচারের জন্য আদালতে প্রেরণ করা হচ্ছে। এখন ধর্ষণরোধে সবার আগে জরুরী সচেতনতা। পরিবার থেকে যদি তার সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখা হয় কিংবা নজর দেওয়া হয় তার কর্মকাণ্ডের প্রতি তবেই ধর্ষণ কমে আসবে।’
এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বর্তমানে যেসকল ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, সবকিছুই সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে। কেএমপির পক্ষ থেকে স্কুল-কলেজের সামনে থেকে বখাটেদের দূর করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন পরিবার থেকে যদি সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখা হয় তাহলে ধর্ষণের শিকার কেউ হবে না।’