ঐতিহাসিক দেবহাটা মুক্ত দিবস ৬ ডিসেম্বর

0
1281

আব্দুর রব লিটু,দেবহাটা : ঐতিহাসিক দেবহাটা মুক্ত দিবস আজ ৬ডিসেম্বর শুক্রবার। ১৯৭১ সালের অগ্নীঝরা এই দিনে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন দেশের লাল সবুজের পতাকা উড়ে দেবহাটার মাটিতে। এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে তাদের হাতে ক্ষত-বিক্ষত দেবহাটাকে মুক্ত করেছিল মুক্তিকামী যোদ্ধারা। সে দিনের মুক্তি পাগল দামাল ছেলেদের উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠেছিল আকাশ-বাতাশ। ৭১ সালের নভেম্বর শেষ, ডিসেম্বর মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে পাক হানাদার বাহিনীদের রুখতে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এলাকায় এসে দেশকে হানাদার মুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল এলাকার দামাল ছেলেরা। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাঁথা এই দিনে দেবহাটা উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিলো। উড়েছিলো বিজয়ের পতাকা। পাক হানাদার মুক্ত হয়ে আনন্দের হাসিতে ভরে উঠেছিল সমগ্র এলাকার মানুষের মুখ। এই দিনে দেবহাটার মানুষ খুজে পেয়েছিল দীর্ঘদিনের সাধনা যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ। উপজেলা প্রশাসন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে এই দিনটিকে স্মরণ করে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সকালে র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ কর্মসূচিতে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র দেবহাটা ছিল ৯ নং সেক্টরের অর্ন্তভুক্ত। সাতক্ষীরা কোর্ট চত্বরের ট্রেজারীর ৪শত রাইফেল লুট করে তৎকালীন সময়ে আবদুল গফুর, এম এল এ আয়ুব হোসেন ও ক্যাপ্টেন শাহাজান মাস্টার জীবন বাজি রেখে ৯ নং সেক্টর গঠন করে। এই ৯ নং সেক্টরের আওতায় ৩ টি সাব-সেক্টর গঠন করা হয়। তার মধ্যে প্রথম সেক্টরটি ছিল শমসের নগর। যার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা। দ্বিতীয়টি ভারত-বাংলার সিমান্ত বর্তী ইছামতির পাড়ে অবস্থিত ভারতের হেঙ্গলগজ্ঞ ও তৃতীয়টি ছিল টাকীতে। তৃতীয়টির নেতৃত্বে ছিলেন মরহুম ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার।বাংলাদেশের ১১ টি সেক্টরের মধ্যে ৯ নং সেক্টরটি ছিল সর্ববৃহৎ। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের উদ্যোগেই ভারতের টাকীতে গড়ে তোলা হয় ৯ নং সেক্টর। সেজন্য ক্যাপ্টেন শাহাজান মাস্টারকে ৯ নং সেক্টরের প্রতিষ্টাতা ও সাব সেক্টর কমান্ডারের খেতাব দেয়া হয়। সমগ্র দেবহাটা থানা ৯ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। শাহজাহান মাস্টারের নেতৃত্বেই এই অঞ্চলের যুবকেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। তিনি দেশ মাতৃকার টানে এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। তখন দেবহাটা এলাকার খানজিয়া ক্যাম্প, দেবহাটা ক্যাম্প, টাউনশ্রীপুর ক্যাম্প, সখিপুর ক্যাম্প, পারুলিয়া ক্যাম্প, কুলিয়া বাজার ও পুষ্পকাটি ইটের ভাটা সহ বিভিন্ন এলাকায় পাক সেনারা ঘাঁটি গড়ে তোলে। দেবহাটা এলাকায় টাউনশ্রীপুর ফুটবল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক সেনাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর এক রাজাকার পাক সেনাদের কাছে পৌছে দেয়। ফলে পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। বিষয়টি ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার বুঝতে পেরে অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ করেন। প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে পাক সেনারা পরাস্ত হয়। এই যুদ্ধে বহু পাক সেনা নিহত হয়। এছাড়া ভাতশালা সহ বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মরহুম ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার। ভাতশালা যুদ্ধের শেষের দিকে হঠাৎ একটি বুলেট এসে মুক্তিযোদ্ধা গোলজারের মাথায় লাগলে সেখানেই তিনি শহীদ হন। এক পর্যায়ে টাউনশ্রীপুরের সেনা ঘাটির পতন হয়। তখন প্রধান সেনাপতি এম. এ জি ওসমানী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মেদ ও সেক্টর কমান্ডার এম. এ জলিল সকলে মিলে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারকে নিয়ে বিজয় উল্লাস করেন। তবে পাক সেনারা এখান থেকে যাওয়ার সময় শাহজাহান মাস্টারের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।অক্টোবর মাসে খান সেনারা খাঁনজিয়া ক্যাম্প ছেড়ে পলায়ন করে। তারা যাওয়ার সময় ঐ এলাকায় এ.পি মাইন পুতে রেখে যায়। ঐ মাইনগুলো অপসারণ করতে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব শহীদ হন। পরে পারুলিয়া, সখিপুর ও কুলিয়া সহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে পাক সেনারা পরাস্ত হয়। তারা চলে যাওয়ার সময় বহু মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং পারুলিয়া ব্রীজ ধ্বংস করে দেয়। এভাবে সেদিন দেবহাটা উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল। আকাশের বুকে উঠেছিল লাল সবুজের বিজয়ের পতাকা। তাছাড়া ভোমরা সম্মুখ যুদ্ধে দেবহাটা সদরের আবুল কাসেমও শহীদ হন। এ সময়ে আর এক বীর সন্তান কুলিয়ার লোকমান হোসেন শহীদ হন। এ ছাড়া দেবহাটা টাউন শ্রীপুর কেদার মাঠে ক্যাপ্টেন শাহাজান মাষ্টারের নের্তৃত্বে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন সাতক্ষীরার কাজল, খোকন, তালার নারায়ন চন্দ্র হোড়, নলতার আবুল কালাম আজাদ।