সাত কলেজ অধিভুক্ত: কে কার গলার কাঁটা?

0
413

সৌরভ সিকদার
সিদ্ধান্তটি যে ভাবেই হোক না কেন ঠিক ছিলো না। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভাল মন্দ ভবিষ্যৎ বিবেচনা করা জরুরি ছিল। আমরা ঢাবির শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। টের পাচ্ছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড় থেকে ভার নামানোর যে সদিচ্ছা থেকে এ ঘটনার জন্ম তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ভার যে অন্য কারো ঘাড়ে পড়লে সেও আহত হতে পারে সম্ভবত সেটা তখন আমাদের মাথায় আসে নি। আসলে আজ এ দুর্দশা হত না, দুর্দশার যে এখানেই শেষ তা বলা যাচ্ছে না, কপালে আরো দুর্ভোগ থাকতে পারে। এমনকি কোথাকার জল গিয়ে কোথায় দাঁড়ায় কে জানে?
আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম বিগত বিশ-ত্রিশ বছরে ঢাবি-র পরিসর বাড়েনি,সুযোগ সুবিধা বাড়েনি, বেড়েছে শিক্ষার্থী-শিক্ষক আর নতুন নতুন বিভাগ। পৃথিবীতে যখন কাগজ ছেড়ে সব কিছু ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে তখনো আমাদের প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ কাগজ নির্ভর। ঢাবির পঁয়তাল্লিশ হাজার শিক্ষার্থী আর দুহাজার শিক্ষকের চাপই সামলাতে হিমসিম খায়, যেখানে আমাদের রেজিস্ট্রার ভবন সেখানে সাত কলেজের দু লাখ শিক্ষার্থীর চাপে ত ভেঙে পড়ার কথা। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে অবকাঠামো ও লোকবল বৃদ্ধি করা অনিবার্য ছিল। অন্যদিকে অ্যাকাডেমিক দিক থেকে আমাদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা সেমিস্টার পদ্ধতি হবার কারণে সারা বছর ক্লাস ও পরীক্ষার চাপে থাকেন, এই চাপের মধ্যে যদি সাত কলেজের খাতা দেখা আর মৌখিক পরীক্ষা নিতে হয় তাহলে তো সুন্নত পালন করতে গিয়ে ফরজ ছুটে যাওয়ার দশা। হয়েছেও তাই, আমাদের অনেক শিক্ষক এখন সারা বছর পরে থাকেন সাত কলেজ নিয়ে, ফলে তার ভাগ্যে অন্নদা সুপ্রসন্ন হলেও ঢাবির বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের স্বরস্বতী পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কাজেই ছাত্ররা তো আন্দোলন করবেই। তারা তাদের স্যারকে ক্লাসে পায় না, তিনি ডিনদের আদেশ (আশীর্বাদ কিনা কে জানে) নিয়ে সাত কলেজে ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা নেন, প্রশ্ন করেন খাতা দেখেন, চশমার পাওয়ার বাড়ে কিন্তু নিজের বিভাগের পরীক্ষার ফল বের করার সময় পান না, ওদিকে বিসিএস এর আবেদনের তারিখ চলে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মাথা তো নষ্ট হবারই কথা। অনেক প্রতিযোগিতা করে তারা তো ঢাবিতেই ভর্তি হয়েছিল, সাত কলেজে নয়। এটা ঢাবির সব শিক্ষার্থীর প্রাণের দাবি, তা ছাত্রলীগ হোক আর নিরপেক্ষই হোক। রাজনৈতিক কারণে এই দাবির বিরুদ্ধে আপাতভাবে ছাত্রলীগ দাঁড়ালেও তা শেষ পর্যন্ত টিকবে কিনা আমার সন্দেহ। কারণ, এই দুর্ভোগের শিকার সে নিজেও। বরং ছাত্রলীগ এখানে একটি সময়োপযোগী ভূমিকা রেখে তাদের অতীতের অশিক্ষার্থীসুলভ আচরণের দূর্নাম মোচন করতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে যদি তারা এটা করতে পারে তাহলে একঢিলে তিন পাখি মারা হবে, ঢাবির শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা ভারমুক্ত হবে, সাত কলেজ হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে আর ছাত্রলীগ-এর মাথায় যুক্ত হবে দারুণ এক সাফল্যের পালক। সাত কলেজ কেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে সে প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন। কিছুদিন আগে কয়েক বার আন্দোলনে নেমেছিল সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তখন তাদের দাবি যথা সময়ে পরীক্ষা হচ্ছে না, ফল হচ্ছে না, তারা পিছিয়ে যাচ্ছে এসব নিয়ে। আর কদিন পরেই তারা আবার রাস্তায় নামবে তাদের কেন ফেল করানো হয়েছে, পাস করাতে হবে এই দাবি নিয়ে। একথা এজন্য বলছি যে কদিন আগে মানবিক অনুষদের একজন শিক্ষক জানালেন, তাকে যে বিষয়ে খাতা দেখতে দেয়া হয়েছিল সেখানে সাতানব্বই জনের মধ্য পাশ করেছে মাত্র সতের জন। এ অবস্থা কম বেশি সব বিভাগে। এর জন্য নিশ্চয় শিক্ষার্থীরা দায়ী নয়, সাত কলেজের শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ দায়ী। ঢাবি শিক্ষকরা যে মানের উত্তরপত্র নিজ বিভাগে পেয়ে অভ্যস্ত সেটা নিশ্চয় পান না সাত কলেজের খাতায়। কাজেই তিনি নম্বর দেবেন কিভাবে আর শিক্ষার্থীরাই বা পাশ করবে কিভাবে? সুতরাং পাশ করার জন্য হলেও একসময় সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা চাইবে ঢাবির রাহুমুক্ত হতে। কাজেই ঢাবির শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন যদি ব্যর্থও হয় সাত কলেজের আন্দোলন ব্যর্থ হবার সুযোগ নেই। কেন না একটা মানের প্রশ্ন, আরেকটা পাশের প্রশ্ন। তাই ঢাবি আর সাত কলেজ কে কার গলার কাঁটা? বোঝা মুশকিল। তবে সুস্থ থাকতে হলে এই গলার কাঁটা যত দ্রুত সম্ভব বের করে ফেলা দরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব বিষয়েই যথেষ্ঠ আন্তরিক এবং অনেক কিছুই ভাল বোঝেন। তাকে বললে তিনি নিশ্চয় বুঝবেন। এখন কে দায়িত্ব নিয়ে এ কাজটি করবেন তাই হচ্ছে দেখার বিষয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা মন্ত্রণালয় দ্রুত বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব নিলে সবারই মঙ্গল।
সৌরভ সিকদারভাষাবিজ্ঞানী ও লেখক, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়