সাতক্ষীরায় লাভজনক শীতকালীন শরিষা ফুলে মধুচাষ : ঝুঁকছেন চাষিরা

0
1096

দেবহাটা (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি, খুলনাটাইমস:
এখন সরিষার ক্ষেতগুলোতে হলুদের সমারোহ। ফুল ফুটেছে, আবার অনেক জায়গাতে ছোট ছোট সবুজ দানা ঝুলছে। এখান থেকে মধু সংগ্রহের এ মৌসুমকে কাজে লাগাতে ব্যাস্থ সময় পার করেন মৌ চাষিরা। তারা মধু সংগ্রহ করে বিক্রি করে তাদের সংসার চালান।
কেউ বা উপার্জিত আয় দিয়ে সংসার খরচ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, ঋণ পরিশোধ, কিনেছেন জমি। মধু বিক্রি করে অনেকের ভাগ্য বদল করছেন তারা। এ ছাড়াও লিচু, কালো জিরা, আমের মুকুল, ধনিয়াসহ বিভিন্ন ফুল গাছ থেকেও মধু সংগ্রহ করা হয়।
কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আদিকাল থেকে মৌমাছি মানুষের নিকট অতি পরিচিত এক প্রকার ক্ষুদ্র, পরিশ্রমী ও উপকারী পতঙ্গ। সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে বলে এদেরকে সামাজিক পতঙ্গ বলা হয়। মৌমাছি থেকে আমরা মধু ও মোম পাই। মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। কোন কোন প্রকার মৌমাছি বাক্সবন্দী করে লালন-পালন বা চাষ করা এবং অধিকতর লাভবান হওয়া যায়।
সাধারণত আমাদের দেশে সাধারণত তিন প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায় পাহাড়ী মৌমাছি, ভারতীয় মৌমাছি ও ক্ষুদে মৌমাছি। এদের মধ্যে পাহাড়ী মৌমাছি এরা আকারে সবচেয়ে বড়। বড় বড় গাছের ডালে, পাহাড়ের গায়ে এরা চাক বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ১০ কেজি। এরা পোষ মানে না তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায় না।
ভারতীয় মৌমাছি আকারে মাঝারি ধরনের। অন্ধকার বা আড়াল করা স্থান গাছের ফোকর, দেওয়ালের ফাটল, আলমারি, ইটের স্তুপ ইত্যাদি স্থানে এরা চাক বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ৪ কেজি। তবে এরা শান্ত প্রকৃতির। তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায়।
ক্ষুদে মৌমাছি আকারে সবচেয়ে ছোট। এরা ঝোপ জাতীয় গাছের ডালে, পাতায় ও শুকনো কাঠি প্রভৃতিতে চাক বাঁধে। চাকার আকার খুব ছোট। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ২০০ গ্রাম। এরা শান্ত প্রকৃতির। তবে এক স্থানে বেশিদিন থাকে না। মধু একান্তভাবে মৌমাছির তৈরী এক প্রকার উপাদেয় খাদ্য। শ্রমিক মৌমাছিরা ফুলের মিষ্টি রস শুষে নেয় এবং তা জমা করে পাকস্থলীর উপরে এক বিশেষ অঙ্গে যাকে মধুথলি বলে। ফুলের মিষ্টি রস মধুথলিতে জমা করার সময় এর সঙ্গে লালা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন উৎসেচক মেশায়। এর ফলে মিষ্টি রস পরিবর্তিত হয়ে আংশিক মধু তৈরী হয়, যা চাকে এনে ঢেলে দেয় মধু রাখার খোপগুলোতে। তরুণ শ্রমিক মৌমাছিরা এ সময় ছুটে এসে ঐ মধু আবার মুখে ভরে এবং তাদের লালার সংগে মিশিয়ে তৈরী করে আসল মধু এবং তা জমা করে খোপে। শ্রমিক মৌমাছিরা জোরে ডানা নেড়ে খোপে রক্ষিত মধু থেকে বাড়তি পানি সরিয়ে দেয়। ফলে এক সময় ফুলের মিষ্টি রস হয়ে যায় ঘন মধু, যা জমা রাখে নিজেদের ও বাচ্চাদের খাবার হিসাবে। মধু জমা রাখার পর খোপগুলোর মুখ মোম দিয়ে বন্ধ করে দেয়। শ্রমিক মৌমাছির পেটের তলায় পকেটের মত ভাজ থাকে মোমগ্রন্থি। সেখানে তৈরী হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতের মত মোম কণা। এ মোম দিয়ে শ্রমিকেরা বানায় বাসা। প্রকৃতি থেকে ভারতীয় মৌমাছি (রাণী ও কিছু শ্রমিক) সংগ্রহ করে অথবা প্রতিষ্টিত মৌচাষীর নিকট থেকে ক্রয় করে মৌচাষ কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়। বাক্সবন্দীর প্রথম ৩/৪ দিন কৃত্রিম খাবার যথা চিনির ঘন সরবত বা সিরাপ দেবার প্রয়োজন হয়। এরপর মৌমাছিরা নিজেদের খাবার নিজেরা সংগ্রহ করে থাকে। কখনো কখনো পরিবেশে খাবার ঘাটতি পড়লে ও কৃত্রিম খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হয়। মধু সংগ্রহ করার সময় আস্ত চাক হাত দিয়ে চিপে মধু বের করা হয়। এ মধুতে মৌমাছির দেহাংশ ও বজ্য পদার্থ বিদ্যমান থাকে।

অপর দিকে বাক্সে লালন-পালন করা মৌমাছির চাক থেকে মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্য মধু বের করা যায়। এতে চাক থেকে শুধু মধু বের হয়ে আসে, অথচ চাক নষ্ট হয় না এবং তা আবার ব্যবহার করা যায়। দেশে খাটি মধুর চাহিদা পূরণ করে পুষ্ঠিহীনতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ মধু শর্করা জাতীয় খাদ্য। যা বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, এনজাইম ও খনিজ পদার্থ থাকে। তাছাড়া সর্দি, কাশি, বাত, ব্যাথা ইত্যাদি জীবানুনাশক হিসাবে ব্যবহার করে। মোম, মোমবাতি, প্রসাধন (কোল্ড ক্রীম, সেভিং ক্রীম, স্নো ইত্যাদি) ঔষধ বিভিন্ন মলম তৈরী ব্যবহার হয়ে থাকে। মধু ও মোম বিক্রয় করে বাড়তি আয়ের সংস্থানের মাধমে পারিবারিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি করে যা সার্বিকভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির দারিদ্র্য দূরীকরনের সাহায্য করে। ফুলের পরাগায়নের মাধ্যমে কৃষিজ, ফলদ ও বনজ গাছ-পালার ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করে ও জীব বৈচিত্রে সংরক্ষনে গুরুপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে মৌমাছি পালন করলে এবং এলাকায় পর্যাপ্ত সহায়ক গাছ-পালা থাকলে একটি বাক্স থেকে মধূ (শীতকালে) ৭/৮ কেজি এবং বছরে ১৮/২০ কেজি খাটি মধু সংগ্রহ করা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় দেবহাটা উপজেলা কুলিয়া বøকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম উদ্যোগ নিয়ে সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ এলাকার মৌ চাষি আল-আমিন হোসেনকে আমন্ত্রন জানায়। আল-আমিন বহেরা এলাকায় ১৫০ হেক্টর জমিতে ২০০টি টব বসিয়ে প্রথম বারে ২৫মন মধু সংগ্রহ করেছেন। পরীক্ষা মূলক চাষে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের মৌ চাষে আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জসিমউদ্দীন জানন, দেবহাটার বহেরায় পরীক্ষা মূলক ভাবে মৌ চাষের টব বসানো হলে প্রথম পর্যয়ে কৃষকদের মঝে ফলন কম হওয়ার ভয় বিরাজ করছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ভয় কেটে কাটানো সম্ভব হয়েছে। অপরদিকে, শরিষা খেতে মৌ চাষ করা হতে এতে প্রাকৃতির থেকে ১০-১৫% বেশি পরাগায়ন ঘটাতে সাহায্য করে। সাথে সাথে ফলন দ্বিগুনবৃদ্ধি পায়। তবে এবছর চাষিদের মনে ভ্রান্ত ধারনা দুর হয়েছে। আগামিতে আরো বেশি চাষ হবে বলে আশা করেন তিনি। এতে একদিকে শরিষার চাষ বৃদ্ধি পাবে সাথে সাথে সল্প পরিশ্রমে শরিষা ফুলের মধু চাষে পরিধি বৃদ্ধি পাবে।
#