শীত মৌসুমে দুবলার চরে যেতে পাইকগাছার জেলে পল্লীতে ব্যাপক প্রস্তুতি

0
960

প্রকাশ ঘোষ বিধান : শীত মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য পাইকগাছার জেলে পল্লী গুলোতে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। নতুন নৌকা ও ট্রলার তৈরি এবং পুরাতন নৌকা মেরামত, জাল বুনা ও জাল শুকানোর ধুম পড়েছে। জেলে পল্লীর নারী-পুরুষরা সুন্দরবনের দুবলার চরে যাওয়ার জন্য কর্মব্যস্ত দিন কাঁটাচ্ছে। সুন্দরবন ও সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতির মধ্য বিরাজ করছে সারা বছরের জীবিকা অর্জনের খুঁশির আমেজ।
পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া, হিতামপুর, মাহমুদকাটী, নোয়াকাটি, কপিলমুনি, কাটিপাড়া, রাড়–লী, শাহাপাড়া, বাঁকা সহ বিভিন্ন গ্রামের জেলে পল্লীর প্রায় ২৪০টি নৌকা বা ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। নতুন নৌকা বা ট্রালার তৈরি, পুরাতন ট্রলারগুলো সংস্কার, জালবুনা, নৌকায় রং করা, জালে গাবকুটে তার রস লাগানো সহ সমুদ্রে যাওয়ার বিভিন্ন কাজ কর্ম নিয়ে জেলে পল্লীর নারী-পুরুষরা ব্যস্ত দিন কাঁটাচ্ছে।
উপজেলার বোয়ালিয়া মালো পাড়ার বিশ্ব বিশ্বাস, দিপংকর বিশ্বাস, সিতেরাম, তাপস বিশ্বাস, কেনা বিশ্বাস, জয়দেব, সুজন, দয়াল মন্ডল, প্রদীপ বিশ্বাসের নতুন নৌকা তৈরি ও পুরাতন নৌকা মেরামত চলছে কপোতাক্ষ নদের তীরে বোয়ালিয়া ব্রীজের দুই পাশে। বোয়ালিয়া মালোপাড়ার বিশ্ব বিশ্বাস ও দিপংকর বিশ্বাস জানায়, নতুন ১টি ট্রলার তৈরি করতে সর্বমোট খরচ পড়ছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। ৬০ ফুট লম্বা ১৭ ফুট চওড়া একটি ট্রলার তৈরি করতে প্রায় ৪শ সেফটি কাঠ লাগে। সব কাট দিয়ে নৌকা তৈরি হয় না। এলাকায় পাওয়া যায় এমন চম্বল, বাবলা, শিরিস, মেহগনী, খৈই কাঠ দিয়ে তারা ট্রলার তৈরি করছে। প্রতি সেফটি খৈ, বাবলা ও চম্বল কাঠ ৫শ টাকা থেকে ১৫শ টাকা দরে ক্রয় করেছে। নৌকা বা ট্রালার তৈরি করতে বিভিন্নস্থান থেকে মিস্ত্রী আনতে হয়। সাতক্ষীরা জেলার, দওগাহপুর গ্রামে ট্রলার-নৌকা মিস্ত্রী শেখ আব্দুল হাফিজ, শেখ মিরাজ হোসেন তাদের দুইটি দলে ৪ জন সহকারী মিস্ত্রী নিয়ে নতুন ট্রলার তৈরির কাজ করছে। মিস্ত্রী শাহ আলম, রবিউল সহ এলাকার মিস্ত্রী দিয়ে পুরাতন ট্রলার মেরামত করা হচ্ছে। ট্রলার তৈরিতে মিস্ত্রীদের থাকা খাওয়া বাদে প্রতিটি নতুন ট্রলার-নৌকা তৈরী বাবদ মজুরী ৭০হাজার টাকা। নৌকা বা ট্রালার তৈরির পর তাতে রং করতে প্রায় ১২টিন আলকাতরা লাগে। পুরাতন ট্রলার-নৌকা মেরামত করতে ২০-৭০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। একটি নতুন ট্রলারে প্রায় ৩ মন পেরেক, ১শ কেজি বলই প্রয়োজন হয়। নৌকা বা ট্রালার তৈরি পর ইঞ্জিন বসাতে ১ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। প্রতিটি মাছ ধরার জাল তৈরি করতে তাদের খরচ হচ্ছে ৯০ হাজার থেকে ১লাখ টাকা।
সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য প্রতি ট্রলারে ২টি জাল প্রয়োজন হয়। প্রতি ট্রলারে জাল ধরার জন্য ৫/৬ জন কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। তাদের থাকা-খাওয়া বাদে প্রতি মাসে ৮/১০ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য নৌকা প্রতি ৫/৬ মাসে সব কিছু মিলে খরচ পড়ে প্রায় ৫/৬ লাখ টাকা। তারা আরো জানায়, এলাকার বিভিন্ন মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে হয়। ৬ থেকে ৭ মাসের জন্য তারা সুদে টাকা নেয়। প্রতি ১ লাখ টাকায় মহাজনদের প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। জেলে পাড়ার অজয় বিশ্বাস জানান, সরকার যদি তাদেরকে ব্যাংকের মাধ্যমে মাছ ধরার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তাদের মাছ ধরে উপার্জিত টাকা ঘরে ফিরে আনতে পারে। তা না হলে মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া চড়া সুদের টাকা শোধ করার পর উপার্জিত টাকা আর ঘরে ফিরে আসে না। তাই জেলে পরিবাররা সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছে, শীত মৌসুমে মাছ ধরতে যাওয়া সময় জেলেদেরকে যেন ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। তাহলে তারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা ফিরে পাবে।
জেলেরা বিভিন্ন মহাজনের অধীনে থেকে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। মহাজনরা জেলেদের পাস পার্মিট করে রাখে। দুবলার চরে রওনা দেওয়ার আগে মংলা থেকে পাসপার্মিট নিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। এ বছর মংলা হয়ে বলেশ্বর নদী দিয়ে দুবলার চরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে করে পাইকগাছার জেলেদের প্রায় ৩ দিন বাড়তি সময় লাগবে এবং খরচ বেড়ে যাবে দ্বিগুন। সমুদ্রে যাওয়া জন্য বন বিভাগ থেকে পাশ পারমিট নেয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে। সব কিছু ঠিক থাকলে পূজা শেষে জেলেরা মাছ ধরার জন্য সুন্দরবনের দুর্বলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। তবে সূত্রে জানাগেছে, বন সু-রক্ষার জন্য বনের ১৩টি চর নিয়ে জেলেরা যে মৎস্য পল্লী তৈরি করে তা এ বছর সীমিত করা হতে পারে বলে জানা গেছে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, বঙ্গোপসাগর উপকূলে মাছ ধরার মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে বন বিভাগ সে মত তারা সব রকম ব্যবস্থা গ্রহন করবে বলে জানান।
বোয়ালিয়া জেলে পল্লীর দিপংকর বিশ্বাস ও বিশ্বজিৎ বিশ্বাস জানায়, দূর্গা পূজার পর উপজেলার সকল ট্রলার এক সঙ্গে রওনা দিবে। মংলা হয়ে সুন্দরবনের দুবলার চরে গিয়ে বাসা বেঁধে অবস্থান নিবে। জীবিকার জন্য প্রতি বছর বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বনদস্যু ও জলদস্যুদের সাথে জেলেদের জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। মাছ ধরার জন্য গভীর সমুদ্রে ভয়ংকর, বিক্ষুদ্ধ উত্তাল ঢেউয়ের সংগে যুদ্ধ করে জেলেদের জাল ফেলে মাছ ধরতে হয়। জেলেপল্লী মানুষের আয়ের উৎস্য সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেদের নেশা ও পেশা হয়ে দাড়িয়েছে। এতো বিপদের সংগে লড়াই করে জীবিকা অর্জনের জন্য জেলে পল্লীর নারী-পুরুষ সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই নিয়ে জেলে পল্লীগুলোতে চলছে প্রস্তুতির মহাকর্মযজ্ঞ।