রুটি বিক্রেতা থেকে যুদ্ধংদেহী তুর্কী প্রেসিডেন্ট

0
186

টাইমস বিদেশ :
অত্যন্ত সাধারণ জীবন দিয়ে শুরু হলেও রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বর্তমানে এমন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন যিনি আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের শাসনামলের পর অন্য যেকোনো নেতার চেয়ে দেশটিকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দেশটির অর্থনীতির অবনতি হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ১২% এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুর্কী মুদ্রা লিরার মূল্য রেকর্ড পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে তুরস্কের এই অর্থনৈতিক দুর্দশা আরো বেশি খারাপ হয়েছে। ইসলাম নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে বর্তমানে তিনি আলোচিত এক রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন। এরদোয়ান ২০০৩ সালের মার্চ মাসে যখন তুরস্কের নেতা নির্বাচিত হন, সেসময় এক ডলারে পাওয়া যেত ১ দশমিক ৬ লিরা। কিন্তু এখন এক ডলারের মূল্য আট লিরারও বেশি। তার শাসনামলের শুরুর দিকে দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল, হয়েছিল ব্যাপক উন্নয়নও। সাম্প্রতিক কালে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বহির্বিশ্বে তার শক্তি প্রদর্শনের জন্য খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যা অনেক দেশকে ক্ষুব্ধ করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা জোট নেটোতে তুরস্কের মিত্র দেশগুলোও তুর্কী প্রেসিডেন্টের এই তৎপরতায় ক্ষুব্ধ। লিবিয়া ও সিরিয়ার সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে তুরস্কের সামরিক বাহিনী। ককেশাস অঞ্চলে নাগর্নো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে তাতেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে তুরস্ক। দুটো দেশের মধ্যে তীব্র লড়াই শুরু হওয়ার আগে তুরস্ক ও আজারবাইজান মিলে চালিয়েছে যৌথ মহড়া। যুদ্ধে আজারবাইজানকে সরাসরি সমর্থন দিয়ে অনেক দেশের সমালোচনার শিকার হয়েছে তুরস্ক। আজারবাইজানিরা ইতিহাস ও সাংস্কৃতিকভাবে তুরস্কের ঘনিষ্ঠ। এছাড়াও তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিকে তেল রপ্তানির জন্য নির্ভর করতে হয় তুরস্কের ওপর। তাদের তেলের পাইপলাইন গেছে তুরস্কের ভেতর দিয়ে। কিন্তু রাশিয়া কয়েক শতাব্দী ধরে এই ককেশাস অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করে আসছে। লিবিয়া ও সিরিয়া এবং সবশেষ ককেশাসে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রভাব বিস্তারের আকাক্সক্ষা ও সেই লক্ষ্যে সামরিক তৎপরতার কারণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গেও তার বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সম্প্রতি গ্যাসের যে বিশাল ভা-ারের খোঁজ পাওয়া গেছে সেটিও উঠে এসেছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডায়। সাইপ্রাসের সমুদ্র উপকূলে গ্যাসের সন্ধানে তুরস্কের তৎপরতায় সাইপ্রাস ও গ্রিসের সরকার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এই দুটো দেশই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য। এ বিষয়ে ইইউও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে সতর্ক করে দিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ অবজ্ঞা করে এরদোয়ান উত্তর সাইপ্রাসে তুর্কী জাতীয়তাবাদী নেতাদের স্বঘোষিত সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তুরস্কই একমাত্র দেশ যারা এই স্বীকৃতি দিল। সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল।ম্যাকরোঁ ফ্রান্সে ইসলামপš’ীদের দমনে তৎপর হলে এবং ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করলে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ফরাসি প্রেসিডেন্টের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা বলেছেন। ফরাসী পণ্য বয়কটেরও ডাক দিয়েছেন তিনি। এত ফ্রান্স ক্ষুব্ধ হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, বহু আগে থেকেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বেশ কিছু ইসলামপš’ী এজেন্ডা রয়েছে। মিশরে নিষিদ্ধ-ঘোষিত রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে রয়েছে তার আদর্শগত মিল। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীদের মতো তিনিও চার আঙুল তুলে স্যালুট দেওয়ার জন্য পরিচিত। এভাবে শুভেচ্ছা জানানোকে বলা হয় ‘রাবা’। এবছরের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক একটি ভবন হাইয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। এতে বহু খ্রিস্টান ও পশ্চিমা দেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নেতৃত্বে ইসলামপš’ী দল জাস্টিস এ- ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা একেপি ২০১৯ সালে সারা দেশের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে জয়লাভ করে। কিন্তু বড় তিনটি শহর- ইস্তাম্বুল, রাজধানী আঙ্কারা এবং ইজমিরে তার দল পরাজিত হয়। ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির কাছে একেপির পরাজয় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জন্য ছিল একটি বড় ধরনের ধাক্কা। কেননা এরদোয়ান ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই চার বছর এই শহরের মেয়র ছিলেন। আর এই শহরেই তার দুর্গের পতন ঘটেছে। মূলত তুরস্কের রক্ষণশীল গ্রামীণ এলাকা এবং আনাতোলিয়ার ছোট ছোট শহরগুলোই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দল একেপির ভোটের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এই ইস্তাম্বুল শহরেই এরদোয়ানের উত্থানের শুরু। বর্তমানে এই শহরের জনসংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। তার প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠার যাত্রার শুরুতে এই শহর ছাড়াও রাজধানী আঙ্কারায় স্থানীয় নির্বাচনে সাফল্য অর্জন করে তারই দল একেপি। এরপর দলটি ধীরে ধীরে তুরস্কের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে এরদোয়ান ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এরদোয়ান প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হন ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে। তিনি তুরস্কের দ্বাদশ প্রেসিডেন্ট। ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রথম রাউন্ড নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে বিজয়ী হয়ে এরদোয়ান দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর আগের বছর ২০১৭ সালে সংবিধান সংশোধনের ওপর অনুষ্ঠিত বিতর্কিত এক গণভোটেও তিনি জয়ী হন। ফলে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেসময় সামরিক বাহিনীর দিক থেকে তার ক্ষমতা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। তার জবাবে শুরু হয় – পাইকারি গ্রেফতার ও নাম মাত্র বিচার। পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতিকরাসহ মানবাধিকার গ্রুপগুলো প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের এই দমন-পীড়ন অভিযানের তীব্র সমালোচনা করে। সেসময় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মারমারিসের একটি অবকাশ কেন্দ্রে ছুটি কাটাচ্ছিলেন এবং বলা হয় যে তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার ১২ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তিনি তার নিয়ন্ত্রণ পুন-প্রতিষ্ঠা করে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তখন জাতীয় টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হন এবং ইস্তাম্বুলে তার সমর্থকদের বিশাল সমাবেশে যোগ দান করেন যেখানে তিনি নিজেকে “প্রধান অধিনায়ক” হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ওপর এই ঘটনায় কী ধরনের চাপ তৈরি হয়েছিল সেটা বোঝা যায় এর পরের একটি ঘটনায়। বিদ্রোহী সৈন্যদের গুলিতে নিহত তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর জানাজায় বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি জনসমক্ষে কেঁদে ফেলেন। এরদোয়ানের জন্ম ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। একজন উপকূল-রক্ষীর সন্তান তিনি। বেড়ে উঠেছেন তুরস্কের কৃষ্ণ সাগর সমুদ্র উপকূলে। তার বয়স যখন ১৩, তার পিতা সন্তানদের আরো ভালো লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন নিয়ে ইস্তাম্বুলে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিশোর এরদোয়ান বাড়তি কিছু অর্থ রোজগারের জন্য রাস্তায় লেবুর শরবত এবং রুটি বিক্রি করতেন। ইসলামিক স্কুলে লেখাপড়া করেছেন তিনি। পরে ইস্তাম্বুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। একজন পেশাদার ফুটবলারও ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইসলামি মূল্যবোধ আরোপের চেষ্টা করছেন- সমালোচকদের এই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ধর্মনিরেপক্ষতার বিষয়ে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে তিনি বলেছেন, তুর্কীরা যাতে আরো খোলামেলাভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারেন, সেই অধিকারকে তিনি সমর্থন করেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অনেক সমর্থক তাকে “সুলতান” নামে ভূষিত করেছেন যা অটোমান সা¤্রাজ্যের সময়ে ব্যবহার করা হতো। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় অফিসগুলোতে নারীদের হিজাব পরার ওপর কয়েক দশক ধরে যে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল সেটা ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ নতুন এই আইনের বাইরে ছিল। সূত্র: বিবিসি