যশোরে ৩ কিশোর হত্যা : মানবাধিকার কমিশনের ১৩ দফা সুপারিশ

0
165

টাইমস ডেস্ক:
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা ও ১৫ জনকে আহত করার ঘটনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ১৩ দফা সুপারিশ করেছে। গত বৃহস্পতিবার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব আল মাহমুদ ফায়জুল কবীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে কমিটির সুপারিশগুলো কমিশনের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কিশোর হত্যাকা-ের ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এসব সুপারিশ করা হয়। মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০০৯ এর ১৯ (২) ধারা বিধানের আলোকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা পরিবারকে যথাযথ সাময়িক সাহায্য মঞ্জুর করতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা যেতে পারে। এই ঘটনায় যশোরের কোতোয়ালি থানায় করা মামলায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের জন্য কমিশন থেকে নিয়মিত তদারিক করা এবং এই মামলায় কমিশনের নিজস্ব প্যানেল আইনজীবী দিয়ে আইনি সহায়তা দেয়া যেতে পারে। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র ও সমরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য দেশে প্রচলিত শিশু আইনসহ অন্যান্য আইন ও মানবাধিকারের ওপর নিবিড় প্রশিক্ষণের আয়োজন করার জন্য সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ পাঠানো যেতে পারে। প্রশিক্ষণের কন্টেন্ট তৈরি ও প্রশিক্ষক প্রদানের বিষয়ে কমিশন সহযোগিতা করতে পারে। জেলা পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার দায়িত্ব যাদের রয়েছে, যেমন- জেলা ও দায়রা জজ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের মাসে অন্তত একবার শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শনপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এ বিষয়ে তাদের নির্দেশনা প্রদান করতে কমিশন হতে সুপারিশ করা যেতে পারে। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নিবাসীদের জন্য বরাদ্দকরা চাল-ডাল, তরকারি ইত্যাদির মান উন্নয়ন এবং যশোর কেন্দ্রে নিয়োগপ্রাপ্ত বর্তমান ঠিকাদার পরিবর্তন করার জন্য সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালককে বলা যেতে পারে। গত ১৩ আগস্টের নির্যাতনের ঘটনার সময় কর্তব্যরত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো যেতে পারে। নিবাসীদের অপরাধী হিসেবে দেখা, তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা, তাদের দিয়ে কাজ করানো, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুগত নিবাসী তৈরি করা ও অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করা, অভ্যন্তরে মাদকের ব্যবহার ইত্যাদি গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে সমস্যাগুলোর সমাধানে সুপারিশ করা যেতে পারে। নিবাসীদের বয়স ও অভিযোগের ধরন বিবেচনা করে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে রাখার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ পাঠানো যেতে পারে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশেষ করে ইউনিসেফের মনোসামাজিক পরামর্শক (সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর) ও সমাজকর্মী এবং স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের দায়িত্ব থেকে অন্যত্র বদলি করার জন্য তাদের স্ব স্ব কর্তৃপক্ষকে বলা যেতে পারে। তবে শিশু নির্যাতনে সরাসরি যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তারা এই সুপারিশের আওতায় পড়বে না। শিশু উন্নয়ন ও স্বাভাবিক জীবনে একীভূত করার লক্ষ্যে মানসিকতা ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মদক্ষ ও উৎপাদনশীল নাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর জন্য শিক্ষার স্তর মাধ্যমিক পর্যন্ত উন্নীতকরণ, একজন ডাক্তারের স্থায়ী পদ তৈরিসহ জনবল বাড়ানো এবং খাবারসহ সার্বিক মান উন্নয়নের জন্য বাজেট বাড়াতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে বলা যেতে পারে। শিশু আইন-২০১৩ এর আলোকে যেহেতু শিশুদের বিষয়ে এখতিয়ার শুধু শিশু আদালতের, তাই শিশু আদালতের বিচারককে মাসে একবার শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শনের জন্য অনুরোধ করতে আইন ও বিচার বিভাগের এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে সুপারিশ করা যেতে পারে। এছাড়া জেলা পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পরিদর্শন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো যেতে পারে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহ্বায়ক করে জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা, জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা, জেলায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্যানেল আইনজীবী, জেলা পর্যায়ে শিশু অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন, এমন সনামধন্য বেসরকারি সংস্থার দুজন প্রতিনিধি ও জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক। প্রসঙ্গত, যশোর সদরের পুলেরহাটের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) গত ১৩ আগস্ট দুপুর ১২টা থেকে বিকেল পর্যন্ত ১৮ কিশোরকে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নির্দেশে তাদের অনুগত ৮ কিশোর পৈশাচিক নির্যাতন করে। ভুক্তভোগী কিশোরদের হাত-পা বেঁধে ও মুখের ভেতরে কাপড় গুঁজে লোহার রড, পাইপ ও কাঠ দিয়ে মারধর করা হয়। প্রথমবার মারধর করার পর তারা অচেতন হয়ে যায়। এরপর অচেতন অবস্থা থেকে জ্ঞান ফেরা মাত্রই আবারও দফায় দফায় নির্যাতন করা হয়। মারধরের পর তাদের ডরমেটরিতে ফেলে রাখে কর্তৃপক্ষ। সেদিন এমনিতেই তাপমাত্রা ছিল বেশি, তারপর সেদিন তাদের কিছুই খেতে দেয়া হয়নি। নির্যাতন, ক্ষুধা আর চিকিৎসাহীন অবস্থায় এক জায়গায় গাদাগাদি করে রাখায় সন্ধ্যার দিকে পর পর তিন কিশোর মারা যায়।