বারবার বাড়ানো হয়েছে খুলনা-মংলা রেললাইন প্রকল্পের সময় ও ব্যয়

0
132

টাইমস ডেক্স: খুলনা থেকে মংলা গুরুত্বপূর্ণ পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ কাজ ৩ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এক দশকেও তা শেষ হয়নি। ওই প্রকল্পের অনুমোদন নিয়ে ৬ বছর কোনো কাজই হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ে গত ১০ বছরেও ওই লাইন নির্মাণ করতে পারেনি। বরং বারবার প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়েছে। ফলে এক হাজার ৭২১ কোটি টাকার প্রকল্পের খরচ এখন প্রায় ৩ গুণ বেড়ে ৪ হাজার ৩২৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট-১ এবং ৩ ওই দু’টির আওতায় নেয়া ঋণে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। এমন অবস্থায় রেলওয়ের পক্ষ থেকে আবারো সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আইএমইডি ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১০ সালের ডিসেম্বরে একনেকে খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণে এক হাজার ৭২১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩ বছরে সমাপ্ত করার জন্য প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে ওই প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। অনুমোদনের ৫ বছর পর প্রকল্পের ডিজাইনসহ বিভিন্ন অঙ্গে পরিবর্তন আনা হয়। প্রাথমিকপর্যায়ে এলাইনমেন্ট চূড়ান্তকরণে দেরি হওয়ায় ফাইনাল সার্ভে, এলএ প্লান এবং ডিটেইল ডিজাইন করতে দেরি হয়। অ্যাপ্রোচ রোড ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক সর্বশেষ ভূমি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে। তারপর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জুন, তারপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর এবং তারপর ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বর্ধিত করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যস্ত বাস্তবে কাজ হয়েছে মাত্র ৬৩ শতাংশ। অথচ ওই সময়ে ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ করার কথা ছিল। আর অর্থ খরচ হয়েছে ৬৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। নতুন করে ব্যয় ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা হওয়ায় সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৪৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং ভারতীয় ঋণের ২ হাজার ৩৭১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তারপর আবারো সময়ে বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩২৯ কোটি ১০ লাখ ৯৮ হাজার টাকা আর আগামী ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেড় বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আর প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো হলো- ভূমি অধিগ্রহণ, খুলনা থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার মেইন লাইন নির্মাণ, ২১ দশমিক ১১ কিলোামিটার লুপ লাইন নির্মাণ, ৮টি রেলওয়ে স্টেশন, ৩১টি মেজর ও মাইনর ব্রিজ, ১১২টি কালভার্ট, রূপসা নদীর উপর ৭১৬.৮০ মিটার ব্রিজ নির্মাণ এবং রূপসা সেতুর দুই প্রান্তে ভায়াডাক্ট নির্মাণ।
সূত্র জানায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ অঞ্চলকে ঢাকার সাথে সরাসরি সংযোগ করার জন্য পদ্মা নদীর উপর একটি বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। ওই সেতুতে ব্রডগেজ রেলওয়ের সুবিধা বিদ্যমান। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জাতীয় যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। প্রথমপর্যায়ে পদ্মা রেলওয়ে সংযোগ ভাঙ্গা পর্যন্ত হবে। দ্বিতীয়পর্যায়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ বর্ধিত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য মংলা বন্দরকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করা প্রয়োজন। তাতে খুলনা-মংলা রেলপথ প্রকল্পের মাধ্যমে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান ওই রেলপথের মাধ্যমে মংলা বন্দর ব্যবহার করে তাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য করতে পারবে। বতর্মানে ফুলতলা স্টেশন থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ বিদ্যমান। বিগত ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণে মাঠপর্যায়ের কাজ আরম্ভ করা হয়। কিন্তু কাজ আরম্ভ করতে গিয়ে দেখা যায় মাটির গুণাগুণ আশানুরূপ নয়। ফলে নতুনভাবে ডিজাইন রিভিউ করে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে গ্রাউন্ডিংসহ পাইলিং কাজ করতে হয়েছে। তাতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় লেগে যায়। বিষয়টি ইআরডি ও ভারতীয় হাইকমিশনকে অবহিত করা হয়েছে। তাছাড়া কোভিডের কারণে কাজ বিভিন্ন সময় স্থগিত থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা প্রয়োজন পড়েছে। আর এখনো ট্র্যাক নির্মাণ কাজের চুক্তিপত্রের বিপরীতে দাখিলকৃত প্রথম ভেরিয়েশন প্রস্তাব অনুমোদিত হয়নি। ফলে কাজের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরকালে ২০১০ সালে ১২ জানুয়ারি একটি যৌথ বিবৃতি ইস্যু করা হয়। তাছাড়া সার্ক মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট স্টাডি থেকে মংলা পোর্টের মাধ্যমে নেপাল, ভুটান মালামাল আমদানি বা রফতানি করতে পারে বলে প্রস্তাব করা হয়। তারই ফলশ্রæতিতে ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনা-মংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণসহ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওই প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার কথা। প্রকল্পটি ভারত সরকারের (এলওসি) ঋণের অর্থে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অনুমোদিত ব্যয়ের মধ্যে ভারতীয় ঋণ এক হাজার ২০২ কোটি ৩১ লাখ ১৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ৫১৯ কোটি টাকা। তারপর ব্যয় ১২০ দশমিক ৮৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা করা হয়। আর প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনো অগ্রগতি নেই। কারণ খুলনা-মংলা রেললাইনের দ্বিতীয় প্যাকেজের জন্য জলপাইগুড়ি থেকে আনা ¯িøপার ব্যবহার অযোগ্য বলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রতিবেদন দিয়েছে। আর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সাফ জানিয়ে দিয়েছে মানহীন পণ্য ব্যবহার করা হবে না। ফলে ওই রেললাইনের কাজ শেষ হতে আরো একটু দেরি হতে পারে।
এদিকে প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার ব্যাপারে আইএমইডি বলছে, জমি অধিগ্রহণে দেরি, কাজের মাঝামাঝি এসে পরামর্শক পরিবর্তন করতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে ‘সিইজি-নিপ্পন কই জেভি’ থেকে স্টপ কনসালট্যান্ট দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু কিছু জটিল নন-টেন্ডার আইটেম আসায়, যেমন অত্যধিক লুজ সয়েল থাকায় ট্রিটমেন্ট, পাইল বারবার ফেল করায় ও বেস গ্রাউন্ডিং একং অধিক সংখ্যক আনাড়ি সাবকন্ট্রাক্টর নিয়োগ দেয়া। ওসব কারণে প্রকল্পের কাজ বারবার পিছিয়েছে। আর পরিকল্পনা কমিশন বলছে, আগে থেকে মাটি পরীক্ষা করে প্রকল্পের এলাকা নির্ধারণ ও ওই অনুযায়ী ডিজাইন প্রণয়ন করা হলে প্রকল্পে এতোটা সময়ক্ষেপণ হতো না। পাশাপাশি ঋণদাতার কাছেও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতো না।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় ব্যয়ের প্রকল্পগুলো নেয়ার আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি ভালোভাবে করা জরুরি। প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের বিষয় থাকলে সেগুলোকে আগে সমাধান করা দরকার। ডিজাউন ও নকশাগুলো ভালোভাবে করা জরুরি। তারপর মূল প্রকল্প প্রস্তাব করা উচিত। ওই প্রকল্পটি নেয়ার আগে অবশ্যই মাটি পরীক্ষা ঠিকমতো করা উচিত ছিল। বিদেশী ঋণের প্রকল্প সময়মতো শুরু ও শেষ করতে না পারলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। সেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তদারকির গাফিলতি আছে বলেই প্রকল্পে এতোটা সময় লাগছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান জানান, এখন তো করোনা পরিস্থিতি চলছে। তাতে কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রকল্পের ঠিকাদার হলো ইন্ডিয়ান। মালামাল ইন্ডিয়া থেকে আসে। করোনায় ইন্ডিয়ার অবস্থা এখন শোচনীয়। এমন অবস্থায় প্রকল্প কাজ বাধাগ্রস্ত হবে এতে কোনো সংশয় নেই। তবে কাজ বন্ধ রাখা হয়নি। ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজ ৭৬ শতাংশ সমাপ্ত হয়েছে। আশা করা যায় বাকি কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। তবে বতর্মানে করোনা পরিস্থিতির যে অবস্থা বিরাজ করছে তার উপর নির্ভর করছে মাঠপর্যায়ের ওই কাজ সম্পন্ন করা। করোনার মাঝেও স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক নিরাপত্তা বজায় রেখে কাজ চলমান রাখা হয়েছে। তবে মেয়াদ দেড় বছর বৃদ্ধির প্রস্তাবনায় অন্যান্য ইস্যুও আছে।