পাকিস্তানে ইমরান খানের জমানায় কী হতে যাচ্ছে?

0
769

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ২০১৮ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনটি যে বেশ অন্যরকম হবে তার সংকেত শুরু থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। আগের নির্বাচনের পর চারটি বছর পিএএমএল-এন-এর নওয়াজ শরিফ তার প্রধানমন্ত্রীত্ব ভালোভাবে চালালেও গত বছর জুলাই মাস থেকে তার পতনের পথ প্রশস্ত হয়। দুর্নীতির দায়ে বিদ্ধ করে শরিফকে প্রধানমন্ত্রিত্বের পথ থেকে সরানো হয়; তার দলের মধ্যে দেখা দেয় চরম গোলমাল।

আর এই বছর ২৫ জুলাই নির্বাচন হওয়ার ঠিক সপ্তাহ তিনেক আগে মেয়ে মারিয়াম এবং জামাতা ক্যাপ্টেন সফদার সহ শরিফকে জেলে ঢোকানো হয় ফের সেই দুর্নীতির অভিযোগে। আর এরপর বিরোধীদের চরম হট্টগোল এবং সন্ত্রাসবাদীদের  দাপটের মধ্যেই এই প্রবল বিতর্কিত নির্বাচনে বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসে প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও পিটিআই-এর নেতা ইমরানই যে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন, সে বিষয়ে এই মুহূর্তে বিশেষ সন্দেহ নেই। সেদেশের একাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বিখ্যাত এই ক্রীড়াবিদ-রাজনীতিক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন, এটা ভেবেই অনেকে বেশ রোমাঞ্চিত।

পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পিটিআই চেয়ারপার্সন ইমরান খান

প্রশ্ন হলো, রাজনীতির মতো রূক্ষ বাস্তবিক ভূমিতে কি রোমান্টিসিজম কাজে দেবে? এ যদি পশ্চিমের কোনো ধনী দেশের কথা হতো যেখানে আর্থ-সামাজিক সমস্যা এখনও সেরকম ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি, সেখানে তাও নাহয় রোমান্টিসিজম-এর তত্ত্ব চলত; কিন্তু পাকিস্তানের মতো দেশে সেই কল্পিত সুখের স্থায়িত্ব বেশি দিন হওয়া কঠিন।

বেহাল অর্থনীতি

এর সর্বপ্রথম কারণ অবশ্যই হচ্ছে অর্থনীতি। ইমরান খান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে পাকিস্তানে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে তার প্রাজ্ঞতা এখনও আমরা জানি না। নির্বাচনী ইশতেহারে আর পাঁচটা দলের মতো তার পিটিআইও ভালো ভালো কথা বলেছে ঠিকই, কিন্তু পাকিস্তানের বেহাল অর্থনীতিকে পথে তিনি আনবেন কীভাবে, সেটা এখনও কোটি টাকার প্রশ্ন। আমদানি-রফতানির মধ্যে বিরাট ফারাক তো বটেই, সেদেশের বিদেশী মুদ্রার পরিমাণের অবস্থাও বিশেষ ভালো নয়। সরকার কর আদায় করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ।

অতীতে আমেরিকানদের গলগ্রহ হয়ে থাকা দেশটি এখন অর্থনৈতিক হাল ফেরাতে চীনের দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু সেটা তো কোনো সমাধান নয়। নিজের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর না করে অন্যের দয়াদাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকা কোনো সভ্য দেশের নীতি হতে পারে না। পাকিস্তানের শাসকরা দেশের সামরিক শক্তিকে উন্নত করতে যতটা না খেটেছেন দশকের পর দশক, তার অর্ধেকও করেননি দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্যে। এই ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই ইমরান কতটা কী করতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়।

২৫ জুলাই পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের আগে একটি জনসভায় বক্তব্য রাখছেন পিটিআই নেতা ইমরান খান

রাজনৈতিক ‘ম্যানেজমেন্ট’

দ্বিতীয়ত, ইমরান খানের সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। একে তো সরকার গঠনে তাকে অন্যান্যদের সমর্থনের উপরে নির্ভর করে থাকতে হবে, তার উপরে সাম্প্রতিক নির্বাচনে হেরে গিয়ে পিএমএল-এন এবং পিপিপি সহ বিভিন্ন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল রীতিমতো ফুঁসছে। ইমরান খানের প্রশাসনকে যে তারা আগামী দিনগুলিতে সহজে জায়গা ছেড়ে দেবে না, তা বলাই বাহুল্য। তার উপরে পাকিস্তানি সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেটে পিটিআই-এর ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কম যার, ফলে আইনি প্রেক্ষিতেও পিটিআই-এর রথেরও নানা গেরোয় আটকে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রশাসনে অনভিজ্ঞ ইমরানের পক্ষে একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশাসনিক বাধা পেরিয়ে এগোনো কতটা সাবলীল হবে, দেখার ব্যাপার সেটিও।

সন্ত্রাসবাদ

তৃতীয়ত, সন্ত্রাসবাদের প্রশ্ন। পাকিস্তানের গণতন্ত্র যতই সাবালক হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন নির্বাচনের মাধ্যমে, সেখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখনও প্রচুর ফাঁকফোঁকর রয়ে গেছে এবং সেসবের সুবিধা নিয়ে উগ্রপন্থীরা নিরাপদেই চালাচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ড। এই নির্বাচনের প্রাক্কালে দেখা গেছে একদিকে যেমন সন্ত্রাসবাদীরা নিশানা করেছে জনসভাগুলোকে, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো এবং তাদের নেতৃত্বকে, অন্যদিকে আবার পশ্চিমের চোখে উগ্রপন্থী এমন গোষ্ঠীকে দেখা গেছে ইমরান খানের দলকে সমর্থন করতে। অতীতে পাকিস্তানের অসামরিক নেতৃত্বকেও দেখা গিয়েছে সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থন দিতে যাতে ‘ভারতকে শাস্তি’ দেওয়ার চিরকালীন নীতিকে জল ও সার দিয়ে স্বাস্থ্যকর রাখা যায়।

পাকিস্তানের মানুষের এই কান্নার রোল কি থামাতে পারবেন ইমরান?

ইমরান খান যদিও নির্বাচনের পরের দিন, অর্থাৎ ২৬ জুলাই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বলেন যে সম্পর্ক উন্নত করতে ভারত যদি এক পা এগোয়, পাকিস্তান দুই পা এগোবে, কাজের ক্ষেত্রে সেটা করে দেখানো খুব সহজ হবে না। ইমরানের পূর্বসূরি নওয়াজও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে; এমনকি, এই নির্বাচনের আগে ২৬/১১ সন্ত্রাসবাদী হামলায় পাকিস্তানের ভূমিকারও কড়া সমালোচনা করেন তিনি। কিন্তু আখেরে তাতে চটে যায় পাকিস্তানের ভারত-বিরোধী শক্তিশিবিরগুলোই। ইমরানের ক্ষেত্রেও অন্যথা হওয়ার সম্ভাবনা বিশেষ নেই। আগে দেশের সন্ত্রাস দমনের নীতি নিয়েই নতুন প্রধানমন্ত্রীকে ভাবতে হবে; অতঃপর তার প্রশাসনের সাফল্যের পর্যালোচনা হওয়া সম্ভব।

বিদেশনীতি

চতুর্থত, বিদেশনীতি। ইমরান খানের বিদেশনীতি যে বাস্তব জমিনে কী রূপ নিতে চলেছে, সে বিষয়ে কারও সম্যক ধারণা নেই এখনও। চীনের সঙ্গে পিটিআই নেতা ভালো সম্পর্কের কথা বললেও অতীতে পিটিআই-এর বিরোধী রাজনীতির জন্যে চীন রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং-এর পাকিস্তান সফর বানচাল হয়েছে; পাকিস্তানের বহুচর্চিত চায়না-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর প্রকল্প উদ্বোধনে দেরি হয়েছে। সেই পিটিআই আজ যখন ক্ষমতায়, তখন চীন-পাকিস্তানের দোস্তি কী আগের মতোই থাকে কী না তাতে নয়া সমস্যার উদ্রেক ঘটে, দেখার ব্যাপার সেটিও।

দলের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তান পিপলস পার্টির শীর্ষ নেতা বিলাবল ভুট্টো জারদারি

আর অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক তো হাল আমলে বেশ খারাপ। বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম তো ইতিমধ্যে ইমরানকে ‘পাকিস্তানের ডোনাল্ড ট্রাম্প’ বলেও কটাক্ষ করতে শুরু করে দিয়েছে। অর্থাৎ, ইমরানের রাজনীতিতেও ট্রাম্পের অতি-পপুলিজম দেখা যাচ্ছে। আর তাই যদি হয়ে থাকে, তবে এই দুই নেতার মধ্যে রাতারাতি ভালো সম্পর্কের প্রত্যাশা না রাখাই ভালো। ইমরান অতীতে ট্রাম্পের আফগানিস্তান নীতির সমালোচনা করেছেন এবং পড়শী দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে যে ট্রাম্প এবং ইমরান প্রশাসন খুব সহজে মতৈক্যে পৌঁছবেন না, সে কথা বুঝতে বোধহয় বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

পাক সেনা

ইমরান খানকে অনেকেই বলছেন পাকিস্তানি সেনার হাতের পুতুল। এখন যেহেতু পাকিস্তানি সেনা প্রকাশ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে খুব একটা ইচ্ছুক নয়, কারণ তাতে দেশে বিদেশে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষনের উপরে, তাই তারা অসামরিক নেতৃত্বকে নড়িয়ে দিতে পরোক্ষে সমর্থন দিচ্ছে ইমরানকে- অভিযোগ এমনটাই।

কেমন হতে যাচ্ছে পাক সেনাবাহিনীর সাথে ইমরানের সম্পর্ক? আগের নেতৃত্বের মতো নাকি নতুন কিছু?

নওয়াজ শরিফের নেতৃত্ব পাকিস্তানের সেনা এবং বিচারব্যবস্থাকে চটিয়ে দেয় আর তারা তাই চায় না সেরকমই একটি নেতৃত্ব ফের ক্ষমতায় আসুক। অনভিজ্ঞ ইমরানকে তাদের হয়তো এব্যাপারে মানানসই মনে হয়েছে কিন্তু ক্ষমতায় এসে যদি ইমরান অন্যরূপ ধারণ করেন? ঠিক যেমনটি করেছিলেন ভারতের ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’ ইন্দিরা গান্ধী যাকে তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব মনে করেছিল দুর্বল? রাজনীতিতে কিছুই আগাম বলা সম্ভব নয়।

যা-ই হোক, সবদিক বিবেচনায় ইমরান খানকে এখনও পাকিস্তানের মতো এক ‘প্রায় ব্যর্থ’ রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিশারী বলে মনে হচ্ছে না। তবে তার জমানায় পাকিস্তানের হাল-হকিকত কতটা কী বদলাবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল হলেও তাতে যে রাজনৈতিক মনোরঞ্জনের রসদের খামতি থাকবে না, সেটা চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়।