পাইকগাছায় করোনা দুর্গতদের সহযোগিতায় অনির্বাণ লাইব্রেরি

0
503

শেখ নাদীর শাহ্ :


খুলনা সদর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে পাইকগাছা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এই প্রতিষ্ঠানটি নামে লাইব্রেরি হলেও গত প্রায় ৩০ বছর ধরে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, তথ্য-প্রযুক্তি বিস্তারসহ নানামুখী উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। চলমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও খুলনা-সাতক্ষীরার কপোতাক্ষ নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবকরা সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি নীরবে-নিভৃতে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছেন। চলতি সপ্তাহে দ্বিতীয় দফায় খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

এব্যাপারে কথা হয় প্রতিষ্ঠান থেকে একজন উপকারভোগী পাইকগাছা উপজেলার মামুদকাটী গ্রামের বাসিন্দা আজিজ সরদারের সাথে। পেশায় তিনি একজন ডেকোরেটর শ্রমিক। কিছুদিন আগেই স্বল্প ডেকোরেটর মালামাল (চেয়ার, টেবিল) কিনে সেগুলো ভাড়া দিয়ে মজুরির পাশাপাশি বাড়তি কিছু উপার্জন হতো তার। যা দিয়ে পাঁচজনের সংসার কোনমতে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু করোনা প্রার্দুভাবে প্রায় দুই মাস রোজগার বন্ধ।

তিনি জানান, সকালে দরজা খুলেই দেখলাম দরজার সামনে পড়ে আছে একটি ছোট প্লাস্টিকের বস্তা। বস্তার গায়ে লেখা, আপনাদের পাশে আছে অনির্বাণ লাইব্রেরি। বস্তাটি খুলে দেখি তার মধ্যে ১০ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, ১ লিটার তেল ও একটি ১০০ টাকার নোট। সকালবেলা ঘুমথেকে উঠে এগুলো দেখেই আমার দিনযাপনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যোগানের দুঃশ্চিন্তা কেটেযায়। পূর্বে কোন সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় অনির্বাণ লাইব্রেরির এ উপহার আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।

অনির্বাণ লাইব্রেরির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমানে সিলেট রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র লাইব্রেরির ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, ‘যদিও একটা লাইব্রেরির দৈনন্দিন কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে না, তার পরও দুঃসময়ে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি যেভাবে, যতটুকু পারি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। অনির্বাণের স্বেচ্ছাসেবকরা এলাকার প্রত্যেকটি পরিবারকে সচেতন করে চলেছেন। আশপাশের গ্রাম থেকে যাঁরা দেশের বাইরে বা শহরে ছিলেন, তাঁদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছে। স্বেচ্ছাসেবকরা দরিদ্র কৃষকের পাঁকা ধান কেটে দিচ্ছেন। কালবৈশাখী ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করছে।

অনির্বাণ লাইব্রেরির এধরণের কার্যক্রমে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু। তিনি সাংবাদিকদের জানান, সরকারের পাশাপাশি অনির্বাণ লাইব্রেরির মতো সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের পাশে দাড়ালে যে কোন দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবেলা অনেকটাই সহজ হবে।

অনির্বাণ লাইব্রেরির সভাপতি কালিদাশ চন্দ্র চন্দ সাংবাদিকদের জানান, সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে করোনা পরিস্থিতির শুরুতে এলাকার স্কুল কলেজ ও বাজারগুলোতে হাত ধোয়ার কৌশল শেখানো, লিফলেট বিতরণসহ সচেতনামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তাছাড়া স্যানিটাইজার বিতরণ ও পরিচ্ছন্নতা অভিযানও চালানো হয়। শুরু থেকে লাইব্রেরির সাপ্তাহিক মেডিক্যাল ক্যাম্প থেকে রোগীদের সচেতন করা হচ্ছে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন অসহায় মানুষদের মাঝে বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। লাইব্রেরির সদস্য ও শুভাকাঙ্খীদের কাছ থেকে পাওয়া অনুদানে এই কার্যক্রম চলছে।

খাদ্য সামগ্রী বিতরণে ভিন্ন কৌশলের কথা তুলে ধরে লাইব্রেরির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রভাাষক সরদার মো. আনিসুর রহমান বলেন, সহায়তা গ্রহণকারীরা যাতে লোকলজ্জার মধ্যে না পড়েন, সে বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এজন্য লাইব্রেরির স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন উপায়ে গ্রাামে খোঁজ-খবর নিয়ে তালিকা তৈরি করে। এরপর রাতে গোপনে তাঁদের বাড়িতে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়। আবার অনেকে সরাসরি যোগাযোগ করেন। বাস্তবতা বিবেচনা করে তাঁদের জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

তিনি আরো জানান, সামগ্রিক কাজে সর্বাধিক ভূমিকায় রয়েছেন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক।

অনির্বাণ স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান বিপ্লব মন্ডল বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকাংশরাই গ্রামের বাড়িতে। তারাই লাইব্রেরিতে জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি উপরোক্ত কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ ছাড়াও জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবে তারা কাজ করে চলেছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজন দরিদ্র কৃষকের ধান কেটে দেওয়া হয়েছে এবং ঝড়ে নূয়ে পড়া দরিদ্রদের ঘরও স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করে দেওয়া হয়েছে।

এছাড়াও যে কোনো প্রকার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য আমরা সর্বদা প্রস্তুত বলেও জানান প্রতিষ্ঠানটির এ স্বেচ্ছাসেবক নেতা।