পাইকগাছায় ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সুপারিশে গড়ে ওঠা দেশের প্রথম ভূবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয়

0
412
Exif_JPEG_420

অমল কৃষ্ণ মন্ডল, পাইকগাছা: খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী গ্রামে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সুপারিশে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের (পিসি) পিতার হাতে গড়া দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি আজও জাতীয়করণ হয়নি। একটি নতুন ভবন নির্মাণাধীন থাকলেও মূল ভবন রয়েছে জরাজীর্ণ। অবিভক্ত বাংলার বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিদের এই বিদ্যালয়ে পরিদর্শণ থাকলেও জাতীয়করণ না হওয়া হতাসা বিরাজ করছে অত্র এলাকা সহ খুলনা বাসীর। শিক্ষক – শিক্ষার্থীরা গর্বিত হলেও অজানা বেদনা তাড়িয়ে বেড়ায়। শিক্ষা বান্ধব প্রধান মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সুধী মহল সহ সর্ব স্তরের জনগন।
জানা যায়,খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী গ্রামে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট হরিশ্চন্দ্র রায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) রায়। তাঁর জন্মের ১১ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৫০ সালে তাঁর বাবা হরিশ্চন্দ্র রায় স্ত্রীর নামে ভূবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয়দের দাবী এটি বাংলাদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। অতচ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ১৭০ বছরেও ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠে একটি বহুতল ভবনের কাজ নির্মানাধীন থাকলেও মূল ভবনে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বর্তমানে দেশে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও সে তালিকায় দেশের সর্ব প্রথম প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টি স্থান পায়নি। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, ১৮৫০ সালের পূর্বে কোন এক সময় পাইকগাছার রাড়ুলী গ্রামে বেড়াতে আসেন জ্ঞানের ভানৃডার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি আচার্য্য পিসি রায়ের পিতা হরিশ্চন্দ্রকে নারী শিক্ষার উন্নয়নে একটি আলাদা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের সুপারিশ অনুসারে হরিশ্চন্দ্র রায় স্ত্রীর নামে রাড়ুলী গ্রামে ভূবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্ত্রীকে ঐ বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হিসেবে ভর্তি করেন। এটি বাংলাদেশের ও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ১৬ জন শিক্ষক ও তিনজন কর্মচারী রয়েছেন। ছাত্রী আছে তিন শতাধিক। এ বিদ্যালয় থেকে ২০১৯সালে ৪৫ জন ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয় শতভাগ পাশ করেছে।‘দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি ১১৭০ বছর নারী শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীনতার পর দেশের শত শত নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি আজও জাতীয়করণের আলো দেখেনি।অজ পাড়া গায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের দৃষ্টি গোচর হয়নি। কিন্তু ১৯৩৮ সালের ২০এপ্রিল তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ের নাম শুনেই ছুটে আসেন রাড়ুলী গ্রামে। পরিদর্শণ করেন বিদ্যালয়টি, মন্তব্য লেখেন পরিদর্শণ খাতায়।এগিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষক ও এলাকাবাসীর।পাঁচ বছর পর ১৯৪৩ সালের ২৬ এপ্রিল একই সংবাদ শুনে ছুটে আসেন অবিভক্ত ভারতের ইতিহাসখ্যাত মেঘনাদ সাহা সহ চার জন প্রতিনিধি দল। উনারা নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য বাংলার প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পিসি রায়ের পিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরিদর্শণ খাতায় তাদের মতামত তুলে ধরেন। আরও যে তিন জন বরেণ্য ব্যক্তি প্রতিনিধি দলে ছিলেন তারা হলেন,প্রফুল্ল চন্দ্র মিত্র, বীরেন চন্দ্র গুহ ও বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার।দেশ স্বাধীনের পর ১৯৮৬ সালের১০ জুলাই বিদ্যালয়টি পরিদর্শণ করেন,অধ্যাপক কে,আলী,যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি ইফতেখার হোসেন। ১৯৯২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নায়েমের মহাপরিচালক, ১৯৯৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোঃ ফজলুর রহমান। ২০০২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ডঃ এ এফ এম মনজুর কাদির। প্রত্যেক বরেণ্য ব্যক্তিরা পরিদর্শণ শেষে মন্তব্যে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রায় বিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ কামনা করেছন।আবার বর্তমানে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি)রায়ের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী সরকারী ভাবে পালিত হয় রাড়ুলী গ্রামে। সেখানে সরকারের উচচ মহলের কর্মকর্তা সহ স্থানীয় জন প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে হৃদয় কাপানো বক্তব্য পেশ করেন।অপর দিকে এই বিশ্ব বরেন্য বিজ্ঞানীর মাতার নামে প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বক্তব্য দেন একই মঞ্চে।কবে হবে তাদের প্রিয় বিদ্যাপীট জাতীয়করণ? সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২ আগষ্ট পিসি রায়ের জন্ম দিবসে খুলনা জেলা প্রশাসক, স্থানীয় এমপি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহ সরকারী উচচ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অত্র বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী লাবিবা হাসনাত তার বক্তব্যে বলে, ‘দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করি। কিন্তু যখন অবহেলিত বিদ্যালয়ের করুণ চিত্র দেখি তখন খুব কষ্ট হয়। যে প্রতিষ্ঠান প্রায় ২০০ বছর ধরে নারী শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে, কেউ তার খবর রাখেন না।’ একই আক্ষেপ বিদ্যালয়টির নবম শ্রেণির ছাত্রী ডরতী দাশ ও দশম শ্রেণির অন্তরা খাতুন সহ সকল শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গৌতম কুমার ঘোষ বলেন, ‘১৮৫০ সালে একজন বরেণ্য ব্যক্তির প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর মায়ের নামে হওয়া দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় আজও অবহেলিত। স্বাধীনতার পর দেশের শত শত বালিকা বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে। অথচ ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কিংবা জাতীয়করণে কারও কোনো দৃষ্টি নেই। প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আমরা সকলেই অবহেলিত। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেশের প্রথম এ বালিকা বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের ঘোষণা চাই।’ বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও রাড়ুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ গোলদার বলেন, ‘জাতীয়করণ না করায় দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমরা এ বিষয় নিয়ে জেলা পরিষদ প্রশাসক, স্থানীয় সংসদ সদস্যদেরও জানিয়েছি। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হলে নারী শিক্ষার প্রসারে প্রতিষ্ঠানটি আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে স্থানীয়রা বর্তমান সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবুর উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছেন। তিনি দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টির ব্যাপারে শিক্ষা বান্ধব প্রধান মন্ত্রীর স্মরনাপন্ন হবেন। এ বিষয়ে এমপি আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, নারী শিক্ষা বিস্তারে ভূবন মোহিনী বিদ্যালয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণের বিষয়ে অচিরেই সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরে সুপারিশ পাঠানো হবে।