ক্রিকেটাররা কী ভাতের কষ্টে!

0
503

মোহাম্মদ আবু নোমান
সব সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হওয়া সম্ভব। আন্দোলন, আল্টিমেটাম বা বিদ্রোহ করে নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, কার্যক্রমে অসন্তুষ্ট ক্রিকেটাররা। অবশেষে তারা এক হয়ে তুলে ধরেছেন ১১ দফা। দাবি না মানা পর্যন্ত দেশ-বিদেশের সব ক্রিকেটীয় কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন। এ ঘটনায় ভীষণ আলোড়ন তৈরি হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বে। অনিশ্চয়তায় ঝুলে গেছে বাংলাদেশের ভারত সফর ও চলমান জাতীয় লীগ।
এভাবে ধর্মঘট পালন করা খেলোয়াড়ি মেজাজের পরিচায়ক নয়! কারণ, ক্রিকেটকে বলা হয় ‘ভদ্রলোকের খেলা’। আমাদের ক্রিকেটাররা আজ যেভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উঠেছেন সেটাও সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা আর রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। তাই বিষয়টি একটু অনুধাবন করে অনির্দিষ্টকালের কর্মসূচি নেয়া যুক্তিযুক্ত ছিলো।
বিসিবির বিভিন্ন অনিয়ম, সেচ্ছাচারিতা নিয়ে ইতোপূর্বে ক্রিকেটাররা কথা বলেছেন, এতে নানা পর্যায়ে তাদের শাস্তিও হয়েছে। সাকিব এর আগেও অনেক অনিয়ম নিয়ে, তামিম পিচ্ নিয়ে, মুশফিক টিম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে মন্তব্য করেছিল। তারা কিন্তু ভুল বলেননি, তবুও অধিনায়কত্ব হারানোসহ তাদের শাস্তি পেতে হয়েছে। বিসিবি যদি মনে করে, ক্রিকেটারদের কথা শোনার বা ভাবার সময় তাদের নেই। তাহলে বিসিবির ঘুম (কুম্ভকর্ণ) ভাঙাতে সাকিবদের এরকম একটি ঝাঁকুনি দেয়া ছাড়া আর কি-ই করার ছিলো?
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও মাশরাফির বক্তব্যে দেখা যায়, ক্রিকেটাররা ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণার আগে কারো সাথেই আলোচনা করেননি। মাশরাফি বলেছেন, ‘এই উদ্যোগ সম্পর্কে আমি একদমই অবগত ছিলাম না। এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।’ যদি তাদের কথা সত্যি হয়, তাহলে ক্রিকেটাররা ধর্মঘটের ডাক ও হার্ডলাইনে যাওয়ার আগে পুরো বিষয়টি বিসিবিকে জানাতে পারতেন। শুরুতে হার্ডলাইনে যাওয়ায় ক্রিকেট দুনিয়ায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মাশরাফি বলেন, ‘অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, দেশের ক্রিকেটের এমন একটি দিনে আমি কেন উপস্থিত ছিলাম না..। এই উদ্যোগ সম্পর্কে আমি একদমই অবগত ছিলাম না। নিশ্চয়ই বেশ কিছু দিন ধরেই এটি নিয়ে ওদের আলোচনা ছিল, প্রক্রিয়া চলছিল…। ক্রিকেটারদের নানা দাবির সঙ্গে আমি আগেও একাত্ম ছিলাম, এখনো আছি…। মিডিয়ায় ওদের খবর দেখার পর থেকে হাজারবার আমার মাথায় এই প্রশ্ন এসেছে যে, কেন আমাকে জানানো হলো না…। তবে আমার ঊপস্থিত থাকা কিংবা না থাকার চেয়ে, ১১ দফা দাবি বাস্তবায়িত হওয়াই বড় কথা। সবকটি দাবিই ন্যায্য, ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের মঙ্গলের জন্য জরুরি। আমি মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা, ১১ দফা দাবি শান্তিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার পক্ষে আছি, থাকব।’
দেখা যায় মাশরাফিকে অন্যান্য খেলায়াড়রা খেলা বর্জনের মতো চূড়ান্ত কর্মসূচিতেও জানায়নি। অন্যদিকে মাশরাফি ১১ দফা দাবির সাথেও একাত্ম হয়েছে। তাহলে মাশরাফি কোথায় আছেন- ‘না ঘরকা না ঘাটকা’! অন্যদিকে ক্রিকেটারদের ধর্মঘটে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বিসিবি সভাপতি। সমস্যা সমাধানের সুযোগ না দিয়ে ধর্মঘট করাকে ‘ষড়যন্ত্রের অংশ’ অ্যাখ্যা দিয়েছের নাজমুল হাসান পাপন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ইঙ্গিত করেন এমন ধর্মঘট দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফসল, তারা বোর্ডের ভাবমূর্তি দেশের বাইরে ক্ষুণœ করতে চায়।
বিসিবি সভাপতির ভাষায়, ‘বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই জানে না আসল পরিকল্পনাটা কি। ওরা না জেনেই এসেছে। আসল পরিকল্পনা জানে দু-একজন।’ খেলোয়াড়দের উদ্দেশে তিনি সরাসরিই বলেছেন, ‘এমন ভাব দেখাচ্ছে যে আমরা কিছুই করছি না। তোমরা না খেললে আমাদের কি করার আছে।’ বিসিবি সভাপতি আরও বলেন, ধর্মঘট ডেকে ‘খেলোয়াড়রা এ পর্যন্ত সফল। দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে সফল হয়েছে। ওরা কথা বলার কোনো সুযোগই রাখেনি। সবই পরিকল্পনার অংশ।’ তবে ধর্মঘটে একাত্ম ঘোষণা করা সব ক্রিকেটারই যে জেনেশুনে অংশ নিয়েছেন তা মনে করছেন না বিসিবি সভাপতি। ‘সবাই জেনে শুনে অংশ নিয়েছে বলে মনে হয় না।’
বিসিবির সভাপতির বক্তব্যে হার্ডলাইনের ইঙ্গিত বহন করে। খেলোয়াড়দের ১১ দফা দাবির পূর্বাপর ঘটনায় যদিও বিসিবি এখন সেইফ জোনে। এ কারণে নাজমুল হাসান পাপন ক্রিকেটারদের ‘যেমন কর্মসূচি তেমনি মুগুড় হেঁকেছেন’। বিসিবি বলছে, তাদের আগে বলা হলো না কেন? আমরা মনে করি, সংকট সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করা যাবে না।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ক্রিকেট দ্বারা বিশ্বব্যাপী দেশের যেমন অর্জন রয়েছে, তেমনি সুনামও রয়েছে। তাই বিসিবির বুঝতে হবেÑ ‘দেয়ার বেলায় ঠন ঠন, নেয়ার বেলায় টন টন!’ এটা কাম্য নয়। এর বাইরে ক্রিকেটারদেও বুঝতে হবেÑ বর্তমানে তারা যতটুকু আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করছেন, বিপরীতে তাদের পারফর্ম্যান্সের গতি কতটুকু? বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অনুসারে দাবীগুলো উপস্থাপনের ব্যাপারে ক্রিকেটারদের আরও দায়িত্বশীল ও দেশাত্ববোধ দেখানো উচিৎ ছিল নয় কী? বলা হয়Ñ ‘এ জগতে, হায়; সেই বেশি চায়; আছে যার ভূরি ভূরি…!’ গাড়ি-বাড়ি, দেশ-বিদেশ ট্যুরসহ যতোটুকু আর্থিক সুবিধা ক্রিকেটাররা নিয়ে থাকেন, অন্য কোনো সরকারি বিভাগে কর্মরতরা সর্বোচ্চ শিক্ষিত হয়েও এতো সুবিধা পেয়ে থাকেন কী?
শাকিব-তামিমরা কি দেখেন না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করে আজও সরকারি কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। এসব শিক্ষকরা ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এর বাইরে এদেরও অসুখ-বিসুখ হয়, আছে আত্মীয়-স্বজনও। ভাবা যায়? তারা কেমন আছেন? কিভাবে চলছেন? প্রাণখোলা একটু হাসি তাদের মুখে আছে কি? তারা আমাদের ‘সম্মানিত শিক্ষক’ যারা নন-এমপিও। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা কি দেখেন না, এসব নন-এমপিও শিক্ষকরা, এমনকি মহিলারা দুধের শিশু নিয়েও বেতনের দাবিতে রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে, খোলা আকাশের নীচে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। ইতোপূর্বে বরিশালের জল্লা ইউনিয়ন আইডিয়াল কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক অরুণ কুমার বিশ্বাস বছিলেন, ‘গত ১৮ বছর ধরে আমি শিক্ষকতা করছি। টিউশনি করে চলতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করে শিক্ষকতা পেশায় এসে মানবেতর জীবন যাপন করছি। বিয়ে পর্যন্ত করতে পারিনি। বর্তমানে ছোট বোনের বিয়ের খরচ যোগাতে পারছি না। শিক্ষকতা পেশায় এসে কি তাহলে ভুল করেছি…?’
শিক্ষাদানের মতো মহৎ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা এখনো এমন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সেখানে সাকিব-তামিমরা মনে হয়, বড় ভাতের কষ্টে আছেন। ক্রিকেটারদের দাবিগুলো যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য। ক্রিকেটারদের সুবিধা বাড়–ক, ক্রিকেটেরও উন্নতি হোক। কিন্তু ক্রিকেটীয় কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা না দিয়ে দাবিগুলো বোর্ডের কাছে পেশ করলেই ভালো হতো।
বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট ভক্ত (পাগল)। শুধুমাত্র খেলার বদৌলতে বিসিবির আর্থিক স্বচ্ছলতা বা খেলোয়াড়দের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি হলে, খেলার যেকোনো ফরমেটের র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ২/৪-এ থাকার কথা। ক্রিকেট পাগল পাবলিকের কল্যাণেই ‘ধনী’ বিসিবি, বিশ্বব্যাপী পরিচিতি খেলোয়াড়দের। যার পরিচয় মেলে গ্যালারিপূর্ণ দর্শকের মাধ্যমে। অন্যান্য দেশেতো দেখা যায়, বিশ্বকাপের খেলায়ও খা.খা. ফাঁকা গ্যালারি।
বর্তমানে বাৎসরিক কোটি টাকার কম কোনো খেলোয়ারেরই ইনকাম আছে কী? জাতীয় দলে খেলার বদৌলতে কোনো কোনো খেলোয়াড়তো বছরে বিভিন্ন পর্যায় থেকে শতকোটি টাকা ইনকাম করে থাকেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীও অনেকের সাথেই ডেকে কথা বলেন। অথচ তারা আফগানিস্তানের কাছেও হেরে থাকে। পারফরম্যান্স নিম্নগামী, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী, কিন্তু আয়ের বাসনা ও লিপ্সা যদি হয় ঊর্ধ্বগামী! অর্থাৎ খেলোয়াড়দের ক্ষুধা টাকার প্রতি যতটা, খেলার প্রতি ততটা দৃশ্যমান কী? এজন্য ক্রিকেটারদের পারফর্ম্যান্সের ভিত্তিতে (ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক, যে পর্যায়েই হোক) ভালো মানের বোনাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সম্মানের অভাব দেখছেন ক্রিকেটাররা। জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ওয়েষ্টউন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, শ্রিলঙ্কা ইত্যাদি দেশের ক্রিকেটারদের চেয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সম্মান-মর্যাদা কম দেয়া হয় কী? দেশকে, ক্রিকেটকে ভালোবেসে খেলাকে ‘বিনোদন’ হিসেবে নিয়ে খেলোয়াড়প্রেমিরা ‘টাইগার’ বলে চিৎকার করে থাকে। খেলোয়াড়দের সেখানে খেলাকে শুধু ‘জীবিকা’ হিসেবে নিয়ে তাদের পারফরম্যান্স, কি মানবিকতা বিড়ালের মতো হলে চলবে কী? সম্মান, সচ্ছলতা ও সেলিব্রিটির ভাব নিয়ে, নানা অনৈতিকতায় জড়িয়ে অনেক ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারও ইতোমধ্যে নষ্ট হয়েছে।
সমস্যা থাকতেই পারে কিন্তু যেখানে (ভারত সফর) দেশের নাম জড়িয়ে আছে, এই মুহূর্তে সেখান থেকে সরে আশা ঠিক হয়নি। সামনের খেলা চালিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হতো? একটা সিরিজের আগে দেশের ক্রিকেটকে জিম্মি করে ধর্মঘট ডাকা কাম্য নয়।
খেলোয়াড়দের দাবি যৌক্তিক, কিন্তু এগুলো আগে বোর্ডের সাথে আলোচনা হওয়ার দরকার ছিলো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বোর্ডের সাথে আলোচনা না করেই ধর্মঘট ডাকা হলো। এটা খুবই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। ভারত সিরিজ সামনে অথচ এই সময়ে এই ঘটনা খেলোয়াড়দের মনোযোগে বিশাল ঘাটতি তৈরি হবে।
একথাও ঠিক যে, ক্রিকেটারদের এই ক্ষোভ একদিনে তৈরি হয়নি। এমন একটা বিস্ফোরণ যে অবশ্যম্ভাবী, তা বিসিবির বোঝা উচিত ছিল। দল নির্বাচনে যেনো বোর্ডের কোনো রাজনীতি বা স্বেচ্ছাচারিতা না হয়। বর্তমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজে বা তদন্তের নামে দুই একজনকে যেনো বলির পাঁঠা বানানো না নয়। বিসিসির বক্তব্যে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেগেটিভ দিকটা যেনো ফুটে না উঠে।