আশুরায় করণীয় ও বর্জনীয়

0
1090

 

খুলনা টাইমস:
আশুরা অর্থ হলো ‘দশম’। পরিভাষায় হিজরি বছরের প্রথম মাস মুহাররমের দশম দিনটিকে আশুরা বলা হয়। কোরআন হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী পুরো মুহাররম মাসই মর্যাদাপূর্ণ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা।’ (সহিহ মুসলিম : ১৯৮২)। কিন্তু পুরো মুহাররম মাসের মধ্যে আশুরার দিনটির রয়েছে বিশেষ মর্যাদা।

আশুরার দিনটি সৃষ্টির সূচনা থেকেই সম্মানিত। আল্লাহ তাআলার অনেক গুরত্বপূর্ণ ফায়সালা হয়েছে এই দিনে। নবীজি (সা.) এর আগমনের পূর্বে ইহুদিদের কাছে দিনটি জাতীয় মুক্তির দিবস হিসেবে পরিচিত ছিল। নবীজিও (সা.) আশুরার মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছেন।
আশুরার গুরত্ব : আশুরার দিনটি বিভিন্ন কারণেই পৃথিবীর সূচনা থেকেই গুরত্বপূর্ণ। এর অন্যতম হলো এ দিনে হজরত মুসা (আ.) ফিরাউনের ওপর বিজয়ী হয়েছিলেন। ইহুদিরা দিনটিকে নিজেদের জাতীয় মুক্তির দিন হিসেবে পালন করত।
হজরত আব্দুলাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুলাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন যে ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের বললেন, এ দিনটির বিষয় কী যে তোমরা তাতে রোজা পালন কর? তারা বলল, এটি একটি মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) এবং তার জাতিকে পরিত্রাণ দান করেন এবং ফিরআউন ও তার জাতিকে নিমজ্জিত করেন। এজন্য মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ দিনে রোজা পালন করেছিলেন তাই আমরাও এ দিনে রোজা পালন করি। তখন রাসুল্লাহ (সা.) বলেন, হজরত মুসার (আ.) বিষয়ে তো আমাদের অধিকার বেশি।
এরপর তিনি এ দিবসে রোজা পালন করেন এবং (সাহাবিদের) রোজা পালনের নির্দেশ দেন। (সহিহ বুখারি : ২/৮৬১)। অন্য হাদিসে এসেছে, (মহাপাবন শেষে) আশুরার দিনে হজরত নূহ (আ.) এর নৌকা জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল। তাই হজরত নূহ (রা.) এর শুকরিয়া জানাতে আশুরার দিনে রোজা রাখতেন। (মুসনাদে আহমাদ : ৮৭১৭)। আশুরার দিনে ইহুদিরা ঈদ পালন করত এবং রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে এ দিনের রোজা ফরজ ছিল।
নবীজিও (সা.) হিজরতের পর নিজে আশুরার রোজা রেখেছেন, সাহাবিদের (রা.) রোজার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্ত রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা ঐচ্ছিক করে দেওয়া হয়। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরাও আশুরার রোজা পালন করত। হিজরতের পর নবীজি (সা.) সে দিনে রোজা রেখেছেন, সাহাবিদের (রা.) রোজা রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্ত রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর তা ঐচ্ছিক করে দিলেন।’ (সহিহ বুখারি : ১৮৯৮)।
আশুরার আমল : কোরআন ও হাদিসের শুদ্ধ বর্ণনা অনুযায়ী আশুরার একমাত্র আমল হলো রোজা। নবীজি (সা.) রমজানের রোজার পরই আশুরার রোজার গুরত্ব দিয়েছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি নবীজি (সা.) কে রোজা রাখার ব্যাপারে এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি যেমনটি আশুরার রোজা ও রমজান মাসের রোজার ব্যাপারে দেখেছি।’ (সহিহ বুখারি : ১৮৬৭)।
নবীজি (সা.) আশুরার রোজার প্রতি এত গুরত্ব প্রদানের কারণ হলো আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহ ক্ষমার কারণ হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম : ১৯৭৬)। তবে যেহেতু ইহুদিরা শুধু মুহাররমের দশম (আশুরা) দিনে রোজা রাখে তাই এর ব্যতিক্রম করার জন্য নবীজি (সা.) এর সঙ্গে তাসু’আর (নবম) দিনে রোজা রাখার ইছে করেন।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে মুহাররমের দশ তারিখের (আশুরা) সঙ্গে নবম (তাসুআ) তারিখেও রোজা রাখব।’ (সহিহ মুসলিম : ২৬৬২)। তিনি সাহাবিদেরকেও (রা.) ইহুদিদের রোজার মতো শুধু দশম তারিখে রোজা না রেখে এর সঙ্গে একদিন বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং এক্ষেত্রে ইহুদিদের রোজার ব্যতিক্রম করো। তোমরা আশুরার সঙ্গে এর আগে এক দিন অথবা দিন পরে এক দিন রোজা রাখো।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২১৫৫)।
আশুরার রোজা ছাড়া অন্য কোনো আমল হাদিসে বর্ণিত হয়নি। আশুরার দিন ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা, মুরগি জবাই করা সওয়াবের কাজ মনে করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ‘এ দিন ভালো খবারের ব্যবস্থা করলে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে’ – এ ধরণের বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই কোরআন ও হাদিসে।
আশুরা ও কারবালা: এতে কোনো দ্বিধা নেই যে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর আদরের দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) এর কারবালা প্রান্তরের শোকাবহ ঘটনা ইতিহাসের এক দুঃখজনক অধ্যায়। কিন্তু এ সত্য যে, কারবালা ট্র্যাজেডির হাজার বছর আগে থেকেই আশুরা মর্যাদার দিন হিসেবে অভিহিত হয়ে এসেছে। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই এ কথা বলেন যে, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত আশুরার দিনেই হয়েছিল।
নবীজি (সা.) এর ওফাতের ৫০ বছর পর ৬১ হিজরিতে ইরাকের কারবালা নামক স্থানে নির্মমভাবে শহীদ হন। তাই আশুরার দিনটি একদিকে যেমন ফিরআউনের বিপক্ষে মুসা (আ.) এর বিজয়ের দিন হিসেবে শুকরিয়া আদায়ের দিন অন্যদিকে ইসলামে শোক পালন জায়েজ হলে কারবালার ঘটনার ফলে দিনটি হতো শোকের দিন।
কিন্তু ইসলামে তো কারও মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক পালনের বৈধতা নেই। এমনকি মহানবী (সা.) এর মৃর্ত্যুতেও শোক পালনেও বৈধতা দেয়নি ইসলাম। শরিয়তের বিধান প্রণেতা হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে বলে গেছেন। হজরত হাফসা বিনতে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুলাহ (সা.) বলেন, ‘যে মহিলা আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান রাখে, তার জন্য কারো মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক পালনের অনুমোদন নেই। তবে স্বামীর মৃত্যুতে চার মাস দশদিন শোক পালন করতে পারবে। (নাসায়ী : ৩৫০৩)।
আশুরাকেন্দ্রিক প্রচলিত তা’যিয়া বানানোরও কোনো বৈধতা নেই। অভিধানে তা’যিয়া অর্থ হলো বিপদগ্রস্থ লোককে সান্তনা দেওয়া। বর্তমানে তা’যিয়া বলতে হজরত হুসাইন (রা.) এর কবরের মতো করে একটি কবর তৈরি করা, একে লাল চাদরে আবৃত করে তা নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে শোক পালন করা। এ ধরণের কৃত্রিম সমাধি তৈরি করা ইসলামী চেতনার সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। নবীজির (সা.) ইন্তিকালের পর সাহাবিরা এমনটি করেননি। কোনো তাবেয়ীও এমনটি করেননি।
আশুরা বা অন্য কোনো দিনে যে কারো মৃত্যুতেই বিলাপ বা মাতম করে শোক পালন সম্পূর্ণ হারাম। নবীজি (সা.) মাতম করাকে জাহিলিয়াতের নিন্দনীয় স্বভাব হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মাতম করা কুফুরির পর্যায়ের অন্যায়। নবীজি (সা.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে দুটি চরিত্র কুফুরির পর্যায়ের। একটি হলো বংশ মর্যাদায় আঘাত হানা আর অপরটি হলো কোনো মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে বিলাপ করা।’ (মুসলিম : ৬৭)।
তাই তো যে ব্যক্তি এমন করে তাকে নবীজির (সা.) উম্মতের বাইরের লোক হিসেবে অভিহিত করেছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গালে থাপ্পড় মারে, পকেট ছিড়ে ফেলে ও জাহিলিয়াতের রীতি-নীতির প্রতি আহবান করে সে আমাদের দলভূক্ত নয়।’ (সহিহ বুখারি : ১২৯৪)।
মাতমকারীর ওপর লা’নত বর্ষিত হয়। হজরত আবু উমামা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মুখমল ক্ষত-বিক্ষতকারিনী, পকেট বিদীর্ণকারী এবং দুর্ভোগ ও ধ্বংস প্রার্থনাকারীণীর ওপর লা’নত করেছেন।’ (ইবনে মাজা : ১৫৮৫)। এমন ব্যক্তি যে কি-না কারও মৃর্ত্যুতে মাতম করেছে সে যদি তার এ কাজের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা না করে মারা যায় তাহলে পরকালে তাকে ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হবে।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মাতমকারিণী মৃর্ত্যুর পূর্বে তওবা না করলে কিয়ামতের দিন তাকে আলকাতরার পাজামা ও খোস-পাঁচড়ার ঢাল পরিহিতা অবস্থায় দাঁড় করানো হবে।’ (সহিহ মুসলিম : ৯৩৪)। যে ব্যক্তির মৃর্ত্যুতে বিলাপ বা মাতম করা হয় তার জন্যও বিষয়টি কোনো উপকার বয়ে আনে না। বরং তার জন্যও ব্যাপারটি কষ্টের কারণ হয়।
হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মৃত ব্যক্তি তার কবরের মধ্যে তার জন্য মাতম করে কান্না করার দরন শাস্তি পায়।’ (সহিহ বুখারি : ১২৮৮)। অর্থাৎ সে ব্যক্তি তার উত্তরসূরীদের এহেন কাজের জন্য কবরে থেকে কষ্ট পান। তাই আমাদের উচিত আশুরার দিনে এবং এর আগে কিংবা পরে এক দিন রোজা রাখা।
আশুরার দিনে শোক পালনের অন্যায় পদ্ধতি বর্জন করে হজরত হুসাইন (রা.) যেমন সত্য, ন্যায় ও ইসলামের পক্ষে জীবন দিয়ে জীবনের চেয়ে ইসলামকে বেশি মূল্যবান বলে প্রমাণ দিয়েছেন তেমনি আমাদেরও উচিত ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে নিজেদের উৎসর্গ করা। (তথ্যসূত্র : হাফেজ মাওলানা যুবায়ের আহমাদ: খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ, বোর্ড বাজার, গাজীপুর)।