মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবন ও আদর্শ

0
2144

যুগে যুগে যেসব মহামানব দুনিয়াতে আবির্ভূত হয়ে অকাতরে নিজের জীবন ও ধন উৎসর্গ করে মানব জাতিকে ইহলৌকিক কল্যাণ ও পরলৌকিক মুক্তির পথ দেখিয়ে পৃথিবীকে ধন্য করেছেন, বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মানবজাতিকে সত্য পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য ইসলামের আদর্শ ও সত্যবাণী প্রচার করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। তিনি মানুষের আলোর দিশারী। মানুষের মুক্তি, শান্তি, শিক্ষা ও কল্যানের জন্য তিনি আজীবন সাধনা করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সর্বগুণে গুণান্বিত একজন শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর আবির্ভাবের সময় সমগ্র আরব জাহানে এক চরম অরাজকতা বিরাজ করছিল। গোত্রে গোত্রে কোন্দল, মারামারি, অহেতুক রক্তক্ষয় ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ব্যভিচার, মদ্যপান, জুয়াখেলা, খুন, চুরি, ডাকাতি প্রভৃতি অপকর্মে সমাজে এক ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছিল। নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ। কন্যা শিশু হত্যা করতেও তৎকালীন আরব পিতারা পিছপা হতো না। ঠিক এরকম এক ভয়াবহ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার সুবহে সাদেকের সময় আরবের মক্কা নগরীর বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। তাঁর জন্মের আগেই তাঁর পিতা মারা যান এবং ছয় বছর বয়সে মাতা আমেনাও ইন্তেকাল করেন। তৎকালীন আরবের প্রথা অনুযায়ী তাঁকে শিশু অবস্থাতেই ধাত্রী বিবি হালিমার গৃহে প্রতিপালিত হতে হয়।
পিতামাতার ইন্তেকালের পর হযরত মুহাম্মদ (সঃ) প্রথমে দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং তার মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিবের আদর-স্নেহে লালিত পালিত হতে থাকেন। চাচা আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা অস্বচ্ছল থাকায় তাঁর বাল্যকাল কাটে অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে। তিনি লেখাপড়ার কোনো সুযোগ পান নি। বাল্যকাল থেকেই হযরত মুহাম্মদ (সঃ) খুব পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি চাচা আবু তালিবের মেষ চরাতেন। পাহাড়ের কাছে কাছে মেষ চরানোর সময় প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য তাঁকে ভাবিয়ে তুলতো। তিনি প্রায়ই গভীর চিন্তামগ্ন থাকতেন। একদিন মেষ চরাবার সময় ফেরেশতাদের সাহায্যে আল্লাহ তা’য়ালা হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর বক্ষ বিদীর্ণ করে জমজমের পানিতে তা ভালভাবে ধুয়ে পবিত্র করে দিলেন। ইতিহাসে সেই ঘটনা ‘ছিনাচাক’ বা বক্ষবিদারণ নামে পরিচিত। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর শিক্ষা কোন বিদ্যালয়ে হয়নি। তাঁর শিক্ষার স্থান ছিল সারা দুনিয়া। তিনি প্রকৃতির কাছ থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশ্ব প্রকৃতি ও সৃষ্টি বৈচিত্র্য তাঁর চোখের সামনে অফুরন্ত জ্ঞান ভান্ডার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। বাল্যকালেই সততা ও সত্যবাদিতার জন্য তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর সত্যবাদিতার জন্য আরবের লোকেরা তাকে ‘আল আমিন’ বা ‘বিশ্বাসী’ উপাধি দিয়েছিল।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর বয়স যখন ২৫ বছর, তখন তিনি বিবি খাদিজা নামে মক্কার এক ধনবতী মহিলার প্রতিনিধি হিসেবে সিরিয়াতে বাণিজ্য করতে যান। এই বিধবা মহিলা হযরতের চরিত্র গুণ ও সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হন এবং বিবি খাদিজাকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় বিবি খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর। বিয়ের পর থেকেই হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পরোপকার ও সমাজ সংস্কারে মনোযোগ দেন। তাঁদের বিয়ের পর আরব দেশে দারুন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এসময় মানব প্রেমিক হযরত মুহাম্মদ (সঃ) খাদিজা প্রদত্ত ধনসম্পদ অকাতরে বিতরণ করেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার কাজে। দেশবাসী তাঁর সর্বত্যাগী মানবকল্যাণের মহিমান্বিত রূপ দেখে বিস্মিত হল।
বাল্যকাল থেকেই হযরত মুহাম্মদ (স:) ছিলেন খুবই চিন্তাশীল। তিনি মানুষ সৃষ্টি ও স্রষ্টার কথা গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। তিনি সবসময় সৃষ্টির মূল রহস্যসহ এর সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার কথা চিন্তা-ভাবনা করতেন এবং অসহায় আর্তপীড়িত মানুষকে সাহায্য করার জন্য চিন্তামগ্ন থাকতেন। মাঝে মাঝে তিনি মক্কার অদূরবর্তী হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। তিনি কখনো কখনো একাধারে ২/৩ দিনও সেখানে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। এভাবে দীর্ঘ পনেরো বছর ধ্যান সাধনার পর ৬১১ খ্রিস্টাব্দে চল্লিশ বছর বয়সে তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আল্লাহর প্রেরিত স্বর্গীয় দূত জিবরাইলের (আঃ) মাধ্যমে নবুয়্যত লাভ করেন। এমনিভাবে ঐশী বাণীর মাধ্যমে তাঁর ওপর পবিত্র কোরআন নাযিল হয়। তারঁ ওপর আল কোরআন নাযিল হওয়ার পর থেকে তিনি নবী বা রাসূল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
নবুয়্যত প্রাপ্তির পর হযরত মুহাম্মদ (স:) ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। ইসলাম ধর্মের মূলবাণী হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুল্লাহ’ অর্থাৎ এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ তাঁর প্রেরিত রাসূল।’ এই মহাসত্য তিনি প্রচার করতে থাকেন। এই সত্য প্রচারের জন্য তাঁকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। মক্কার একদল বিপদগামী লোক তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু মহানবী ছিলেন নির্ভীক। কোনো বাধাই তাঁকে সত্যধর্ম প্রচার থেকে বিরত রাখতে পারে নি। ধর্ম প্রচারকালে তাঁর হাতে মহিলাদের মধ্যে বিবি খাদিজা (রা:) ও পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। এভাবে ইসলামের আলো ক্রমশ: চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
মক্কায় কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা যখন বেড়ে গেল এবং ইসলাম প্রচার বাঁধাগ্রস্ত হলো তখন হযরত মুহাম্মদ (স:) আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর হযরত আবু বকর (রা:) সহ মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গমন করেন। মহানবীর এই মদিনা গমনকেই ‘হিজরত’ বলা হয়। হিযরত অর্থ ‘দেশ ত্যাগ’। মদিনার পূর্বনাম ছিল ইয়াসরিব। হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনায় আগমণের পর তার সম্মানার্থে এর নাম রাখা হয় ‘মদিনাতুন্নবী’ বা নবীর শহর-সংক্ষেপে মদিনা। মদিনার আবাল বৃদ্ধ-বনিতা পরম আগ্রহ ও ভালোবাসায় মহানবী (স:) কে গ্রহণ করলেন। এসময় মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। মহানবীর হিযরত ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে ইসলাম নতুন গতি ও নতুন শক্তি লাভ করে। মহানবী (স:) মুহাজির ও আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেন। মুহাজির অর্থ হিজরতকারী। মক্কা থেকে হিজরত করে যাঁরা মদিনায় যান তাঁদেরকে বলা হয় মুহাজির। মুহাজিরদের মদিনায় যাঁরা আশ্রয় ও সাহায্য-সহযোগিতা দিলেন তাঁরা হলেন আনসার। আনসার অর্থ সাহায্যকারী।
মহানবী (স:) মদিনায় হিজরত করে একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন। এখানে মুহাজির ও আনসারসহ সকল মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য মতাদর্শের লোক একত্রে মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে নিরাপদে বাস করবে। তাদের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় থাকবে এবং স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মকর্ম পালন করতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে মদিনার নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে এই উদ্দেশ্যে, তিনি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন। এটিই মদিনার সনদ নামে খ্যাত এবং এটিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সনদ। মদিনার সনদ হযরত মুহাম্মদ (স:) এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কুটনৈতিক দূরদর্শিতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সুন্দর সমাজ গঠনের এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর বহন করে।
মদিনায় ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে দেখে মক্কায় কুরাইশদের ঈর্ষার সূচনা হলো। তারা মদিনাবাসীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং ইহুদীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে ইসলাম ধর্ম ধ্বংস করতে চেষ্টা করে। তাই হযরত মুহাম্মদ (স:) কে বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কয়েকটা যুদ্ধে লিপ্ত হতে হলো। এগুলোর মধ্যে বদরের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিধর্মীরা প্রায় সব যুদ্ধেই পরাজয় বরণ করে। অবশেষে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। হযরত মুহাম্মদ (স:) এর প্রচারিত ইসলাম ধর্মে কোন জাতিভেদ, বর্ণভেদ, উঁচু-নিচু এবং ধনি-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। এজন্যই মহান আল্লাহপাকের এই ধর্ম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে আজ পর্যন্ত টিকে আছে এবং আজীবন টিকে থাকবে।
হযরত মুহাম্মদ (স:) দশম হিজরীতে মক্কায় হজ্ব পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ্ব। তিনি এরপর আর হজ্ব করার সুযোগ পান নি। তাই একে বিদায় হজ্ব বলে। প্রায় একলক্ষ মুসলমান এতে যোগ দিয়েছিলেন। আরাফাত ময়দানে পর্বতের চূড়ার ওপর দাঁড়িয়ে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মর্মস্পর্শী যে ভাষণ দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। এখানে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ঘোষণা করলেন, “মুসলমান সবাই একে অন্যের ভাই। ইসলাম জাতিগত, বর্ণগত, সম্পদগত বা বংশগত মর্যাদায় ছোট বড় ভেদ নেই। সংসারে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার। তাদের একের ওপর অপরের সমান দাবি রয়েছে। দাস-দাসীদের প্রতি তাদের প্রভুদের যথেষ্ট কর্তব্য আছে। প্রভু যা খায়, দাস-দাসীদেরকেও তা খাওয়াতে হবে এবং প্রভু যেমন কাপড় পরে, দাস-দাসীদেরকেও সে রকম কাপড় পরতে দিতে হবে।”
হজ্ব শেষ করে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) মদিনায় ফিরে আসেন। এর তিন মাস পর তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। যতদিন তাঁর শরীরে শক্তি ছিল, ততদিন তিনি নামাজে যোগ দিতেন। কিন্তু শেষে তাঁর শরীর এত দুর্বল হয়ে পড়ল যে, তিনি হযরত আবু বকর (রা:) কে তাঁর পরিবর্তে নামাজের ইমামতি করতে আদেশ দিলেন। তাঁর অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে লাগল। অত:পর ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার ৬৩ বছর বয়সে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ইন্তেকাল করেন। মদিনা শরীফে মসজিদে নববির এক পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। বিশ্বের মুসলমানগন ভক্তিভরে নবীর রওজা জিয়ারত করেন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের মানুষ। ক্ষমা, উদারতা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, সততা, সত্যবাদিতা, দয়া, দানে, কাজে কর্মে, আচার-আচরণে, মানবতা ও মহত্ত্বে তিনি ছিলেন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। সুতরাং আমাদের সকলেরই মহানবী (সঃ) এর জীবনাদর্শ মেনে চলা উচিত। মোঃ আবদুর রহমান