২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস : বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে

0
1617

প্রকাশ ঘোষ বিধান
২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। বিলুপ্তির আশঙ্কায় থাকা মাংসাসী প্রাণী বাঘকে বাঁচাতে ও সচেতনতা সৃষ্টিতে সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশও পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। দেশে সুন্দরবন বাঘের একমাত্র আবাসস্থল। বাঘ বাঁচলে বাঁচবে বন, রক্ষা হবে সুন্দরবন। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বাঘ সমৃদ্ধ ১৩টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণকে বেগবান করতে যে ঘোষণা পত্র তৈরী করা হয় তারই আলোকে প্রতিবছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করা হচ্ছে। বিশ্বে ১৩টি দেশে এখনও বাঘ টিকে আছে। বাঘ সুরক্ষায় বিশ্বের বাঘ সমৃদ্ধ দেশ গুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করছে।
বনবিভাগ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সুরক্ষা, অবৈধ শিকার ও হত্যা বন্ধ এবং বাঘ সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ায় বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। তিন বছর আগের তুলনায় সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা আটটি বেড়েছে। ‘সুন্দরবনের বাঘ জরিপের ফলাফল ঘোষণা ও সেকেন্ড ফেইজ: স্ট্যাটাস অব টাইগারস ইন বাংলাদেশ সুন্দরবন-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এর আগে, ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনা করেছিল বন বিভাগ। মোট বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। সে সময় তাদের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্ব ছিল প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে ২.১৭টি। নতুন জরিপে, বাঘের এই সংখ্যা আটটি বেড়ে ১১৪টি হয়েছে, যা ২০১৮ সালে করা। তিনটি রেঞ্জের তিনটি ব্লকের ১৬৫৬ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিশেষ ধরনের ক্যামেরা দিয়ে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপে বন বিভাগ এবার ৬৩টি পূর্ণবয়স্ক, চারটি জুভেনাইল, পাঁচটি অপ্রাপ্তবয়স্ক বাঘের ২৪৬৬টি ছবি পেয়েছে। এ ছবিগুলো যাচাই করেই বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইউএসএইডের অর্থায়নে বেঙ্গল টাইগার কনজারভেশন অ্যাক্টিভিটি (বাঘ) প্রকল্পের আওতায় এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। এসইসিআর মডেলে তথ্য বিশ্লেষণ করে সুন্দরবনের প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাঘের আপেক্ষিক ঘনত্ব পাওয়া গেছে ২.৫৫ + ০.৩২। সুন্দরবনের বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র চার হাজার ৪৬৪ কিলোমিটার এলাকাকে আপেক্ষিক ঘনত্ব দিয়ে গুণ করে বাঘের সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে ১১৪টি। জরিপে দেখা গেছে, বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জে বাঘের ঘনত্ব পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩.৩৩টি। খুলনা রেঞ্জে সবচেয়ে কম, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১.২১টি বাঘ রয়েছে। জরিপে বন বিভাগকে সহযোগিতা করেছে ওয়াইল্ড টিম, যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ সোনিয়ান কনজারভেশন বায়োলজি ইনস্টিটিউট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
১শত বছর আগে পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১ লাখ। গত এক শতাব্দীর মধ্যে প্রথম বারের মত বিশ্বে বাঘের সংখ্যা বদ্ধি পেয়েছে বলে প্রাণিসংরক্ষণবিদরা জানিয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড ও গ্লোবাল টাইগার ফোরাম জানিয়েছে, সর্বশেষ বিশ্ব শুমারিতে ৩ হাজার ৮৯০টি বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে। সর্বশেষ গণরায় দেখা গেছে, বিশ্বে মোট বাঘের অর্ধেকের ও বেশী ভারতে রয়েছে, যার সংখ্যা ২ হাজার ২শ ২৬টি। ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা ৩ হাজার ২শ টিতে নেমে গিয়েছিল। এক সময় বিশ্বে ৮ প্রজাতির বাঘের পদচারনা ছিল সর্বত্র। প্রজাতিগুলো হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান বাঘ, ইন্দো চাইনিজ বাঘ, কাশিয়ান বাঘ, জাভান বাঘ, সুমাত্রান বাঘ, দক্ষিন চীনা বাঘ ও বালি বাঘ। এর মধ্যে বালি বাঘ, জাভান বাঘ ও দক্ষিন চীনা বাঘ বিলুপ্তির পথে।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, সুন্দরবনে বড় ৬টি শিকারী দল বাঘ হত্যায় তৎপর আছে। তারা সুযোগ পেলে বাঘ হত্যা করে অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন দেশে পাচার করে। পশ্চিম বন বিভাগে শিকারীরা বেশী তৎপর। এ পর্যন্ত শিকারীদের হাতে কত কি বাঘ মারা পড়েছে তার হিসাব বন বিভাগের কাছে নেই। তবে বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত চোরা শিকারী ও বন দস্যুদের হামলা, গ্রামবাসীর গনপিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে সুন্দরবনের ৭০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। তবে পরিমান বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার তুলনায় কমই হিসাবে ধরা পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করে তিন পরিস্থিতিতে বাঘ লোকলয়ে এসে হত্যার শিকার হয়। প্রথমত, বাঘ যে এলাকায় থাকে সে এলাকায় খাদ্যের অভাব। দ্বিতীয়ত, বাচ্চা বাঘ ২ থেকে আড়াই বছর বয়সে মাকে ছেড়ে আলাদা হয়ে যায়। এ সময় বাঘ তার নিজস্ব এলাকা নির্ধারনের জন্য এলাকা খুঁজতে খুজতে বনের বাইরে আসতে পারে। তৃতীয়ত, বৃদ্ধ হয়ে গেলে বা অসুস্থ হরে বাঘ তার নিজ এলাকা হারিয়ে ফেলে। আরেকটি বাঘ তার এলাকা দখল করে নেয়। তখন এই বাঘ খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগে বাঘ লোকালয়ে আসার ঘটনা বেশী ঘটে। বিশ্বে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাঘের আবাসস্থল বাংলদেশের সুন্দরবনের অংশ। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলে যাওয়ায় বাঘের জীবন চক্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বনের বাঘের জীবন সংকটাপন্ন। বাঘের জীবন চক্রের জন্য সুন্দরবনে যে স্বাদুপানি, নিরুপদ্রব, নিরাপদ প্রজনন ব্যবস্থা থাকা দরকার বর্তমান তার কোনটাই যথেষ্ট নয়।
বাঘের বসবাস আছে বিশ্বে এমন ১৩টি দেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রীরা দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের বাঘের সংখ্যা দ্বিগুন করার পরিকল্পনা নিয়েছে বলে বিবিসি’র এক প্রতিবেদনায় জানানো হয়েছে। বাঘ সুন্দরবনের প্রাকৃতিক রক্ষক। বাঘ কমলে সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্যের উপর হুমকি বাড়বে। তাই শুধু বাঘ নয়, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে রক্ষায় এবং সকল জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদের জনগনকে বন সুরক্ষায় আরো বেশী সচেতন এবং উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। আর তা না হলে বিপন্ন হবে বাংলাদেশের গৌরব বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন।
লেখক ঃ সাংবাদিক