স্বামী এবং তার দু’বন্ধু মিলে ধর্ষণের পর স্ত্রীকে হত্যা, রহস্য উদঘাটন কেএমপির, গ্রেফতার ৩

0
191

নিজস্ব প্রতিবেদক:
পারিবারিক অশান্তির জের ধরে স্বামী এবং তার দুই বন্ধু মিলে ধর্ষণের পর স্ত্রীকে হত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে কেএমপি’র হরিণটানা থানা পুলিশ। ঘটনার প্রধান আসামীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছ। স্বামী মোঃ সাইদুর রহমানকে গ্রেফতারপূর্বক বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হলে তিনি হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
গত ৪ জুলাই সকালবেলা হরিণটানা থানা পুলিশ উক্ত থানাধীন রায়েরমহল আন্দিরঘাট ব্রিজের দক্ষিণ পাশে একটি আবাসিক প্রকল্পে কাশবনের মধ্যে থেকে অজ্ঞাত নারীর মৃত দেহ উদ্ধার করে। পরবর্তীতে হরিণটানা থানা পুলিশ অজ্ঞাত নারীর পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হয় এবং জানা যায় যে, মৃত নারী ভিকটিমের নাম শামীমা আক্তার, বয়স ১৮ বছর। নিহত ভিকটিম রায়েরমহল এলাকার বাসিন্দা মোঃ সাইদুর রহমানের স্ত্রী। এই ঘটনায় ভিকটিমের পিতা বাবুল সানা নিহত শামীমা আক্তারের স্বামী মোঃ সাইদুর রহমানসহ অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জনের বিরুদ্ধে হরিণটানা থানার মামলা নং-০১, তারিখ-০৫/০৭/২০২৩ খ্রিঃ, ধারা-৩০২/২০১/৩৪ পেনাল দায়ের করে।
একটি বিচ্ছিন্ন মৃত্যু মানেই শুধুমাত্র কোন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের অবসান নয়, একটি মৃত্যু মানেই একজন মানুষের সংগে তার পরিবার এবং একটি স্বপ্নের মৃত্যু। খুলনা জেলার কয়রা অঞ্চলের আইলা এবং সিডর বিধ্বস্ত এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠির একজন সদস্য বাবুল সানা। অভাবের তাড়নায় হতদরিদ্র অবস্থায় ছেলে এবং মেয়ের হাত ধরে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে খুলনা মহানগরীর হরিণটানা থানার রায়েরমহল এলাকায় এসে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। শুধুমাত্র সংসারের অভাবের কারণে সন্তান দুটির মুখে দুই বেলা দুইমুঠো ভাত তুলে দিতে না পেরে শিক্ষা বঞ্চিত অবস্থায় তার কন্য শামিমা আক্তারকে সাইদুর রহমান নামক একজন পাষন্ডের নিকট বিবাহ দেন পিতা বাবুল সানা। কিন্তু মাত্র ৫ মাসের দাম্পত্য জীবনের ব্যবধানে পাষন্ড সাইদুরের হাতে নির্মম ভাবে খুন এবং ধর্ষণের শিকার হয় শামীমা আক্তার।
দিনটি ছিলো ৩ জুলাই ২০২৩। পারিবারিক কলহের জেরে মেয়ের উপর স্বামীর উপুর্যপরি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাবুল সানা মেয়েকে নিয়ে আসেন তার বসত বাড়িতে। এ বিষয়ে বাবুল সানার পরিবারের সঙ্গে শামীমার স্বামী সাইদুর রহমান এর পরিবারের বাকবিতন্ডা হয়। যার ফলে ক্রমান্বয়ে ক্ষোভ রাগ ঘৃণা এবং প্রতিশোধের আগুন জন্মাতে থাকে সাইদুরের মনে। সাইদুর পূর্ব থেকেই নেশাগ্রস্ত ছিলো। সে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগিদের সাথে নিয়ে প্রতিশোধের পরিকল্পনা আটতে থাকে। যার প্রেক্ষিতে গত ৪ জুলাই রাত অনুমান সাড়ে ৯টায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সহযোগী সোহাগকে নিয়ে সে হাজির হয় বাবুল সানার বসত বাড়িতে। কৌশলে নিজের অভিনয়কে কাজে লাগিয়ে শামিমা আক্তারের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে সামান্য একটি মোবাইল ফোন এবং একটি বোরকা কিনে দেওয়ার জন্য প্রল্ব্ধু করে। শামিমার কোমলমতি মন স্বামীর এহেন কথায় গলে যায়। সে তাকে বিশ্বাস করে, ক্ষমা করে এবং অভাবের কাছে হার মেনে মোবাইল ফোন এবং বোরকা পাওয়ার আশায় নতুন করে সংসার সাজিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন চোখে নিয়ে স্বামীর হাত ধরে বয়রা বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু গন্তব্যে পৌছানোর আগেই হরিণটানা থানাধীন আন্দিরঘাট ব্রিজের নিকট ভ্যান থামিয়ে পাশ্ববর্তী কাশবনের জঙ্গলে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক তার উপর হামলে পড়ে সাইদুর রহমান। সে শামীমাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে শারীরিক মেলামেশায় বাধ্য করে। ইতিমধ্যে ঘটনা স্থলে পৌছে যায় সাইদুরের সহযোগী সোহাগ এবং তপু। তারাও পাষন্ড স্বামী সাইদুরের সম্মতিতে ভিকটিম শামীমাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এরপর আসে সেই অন্তিম মুহুর্ত। সহযোগী সোহাগ চেপে ধরে শামিমার দুই পা, আর তপু চেপে ধরে শামিমার দুই হাত। আর সাইদুর এই ঘটনার মাস্টার মাইন্ড, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তার রাগ ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন নিভাতে চেপে ধরে শামিমার গলা। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই একটি স্বপ্ন এবং একটি অপরিণত সবুজ জীবনের চির অবসান ঘটে।
পরদিন দুপুর নাগাদ হরিণটানা থানা পুলিশ খুঁজে পায় শামিমার মৃত দেহ। তারও একদিন পর গত ৫ জুলাই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিম ঘরে এসে উম্মাদ পিতা বাবুল সানা সনাক্ত করে তার অতি আদরের কন্যা শামিমার লাশ। ঘটনার পর থেকে আসামীগণ পলাতক ছিলেন।
এই ঘটনায় কেএমপি’র পুলিশ কমিশনারের বিশেষ নির্দেশনায় মামলার রহস্য উদঘাটন ও আসামী গ্রেফতারের জন্য হরিণটানা থানায় একটি চৌকস তদন্ত টিম প্রস্তুত করা হয়। গত জুলাই মাস থেকে নিরলসভাবে কাজ করেও হরিণটানা থানা পুলিশ ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও আসামী গ্রেফতার করতে সক্ষম হচ্ছিল না। দীর্ঘ ৩ মাস ধরে নিরলস প্রচেষ্টার পর হরিণটানা থানা পুলিশ অবশেষে গত ২১ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) বিকাল পৌণে ৫টায় আড়ংঘাটা থানাধীন শলুয়া বাজার এলাকায় হরিণটানা থানার একটি চৌকস টিমের নেতৃত্বে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে চাঞ্চল্যকর শামীমা হত্যা মামলার পলাতক প্রধান আসামী নিহত ভিকটিমের স্বামী ও ২নং কয়রা সানাবাড়ী নিবাসী আব্দুর রহিম মোল্লার ছেলে মোঃ সাইদুর রহমান (২১)’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
রায়েরমহলে গৃহবধূ শামীমা আক্তার(১৮) হত্যা মামলার প্রধান আসামী তার স্বামী মোঃ সাইদুর রহমানকে গ্রেফতারপূর্বক বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হলে তিনি হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সেচ্ছায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। এই চাঞ্চল্যকর শামীমা আক্তার ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামী মোঃ সাইদুর রহমানকে গ্রেফতারপূর্বক তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক রায়েরমহল এলাকায় অভিযান চালিয়ে তার বন্ধু রায়ের মহল মন্দিরের মোড় এলাকার জামাল মোল্লার ছেলে মোঃ সোহাগ মোল্লা(২০) এবং রায়ের মহল পশ্চিমপাড়ার মোঃ মকিতুর রহমানের ছেলে মোঃ শরিফুল ইসলাম তপু (২৬) কে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামী মোঃ সাইদুর রহমানসহ তার দুই বন্ধু সোহাগ মোল্লা ও শরিফুল ইসলাম তপুকে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে আসামীদের কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বাকী দুই আসামীকেও পুলিশ রিমান্ডে এনে ঘটনা সংক্রান্তে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মামলাটির তদন্ত অব্যাহত আছে।
পুলিশ জানায়, বর্নিত ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং আবহমান বাংলার চির পরিচিত নারী জীবনের হৃদয়বিদারক চিত্র। আমরা ঘটনার বিষয়ে অত্যন্ত মর্মাহত। আমরা আর কোন পিতা মাতার বুক খালি হোক সেটা চাই না, আর কোন নারীর জীবনের এমন পরিনতি হোক সেটা কামনা করি না। সেই সাথে আমরা সমাজজীবনে নেশার বিস্তার প্রতিরোধে এবং পারিবারিক কলহ নিম্পত্তিতে সকলের অবদান এবং অংশ গ্রহনের আহবান জানাই।