ভবন নির্মাণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উপেক্ষিত বাড়ছে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা

0
211

টাইমস ডেস্ক:
দেশে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত থাকছে। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। তাতে শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তদারকির সংস্থার এদিকে কোনো নজরই নেই। গত দশ বছরে রাজধানীতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১৪ হাজার ৩শ’ ৬জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছে ৭শ’ ৯৩জন। তাদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু জীবন-যাপন করছে। সর্বশেষ গত ২৮ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এলাকায় ঝুলন্ত মাচায় দাঁড়িয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি বহুতল ভবনের ১০ তলার নির্মাণ কাজ করা অবস্থায় মাচা ভেঙে ৩ জনই নিচে পড়ে যায়। তাতে ঘটনাস্থলেই এক শ্রমিকের মৃত্যু হয় এবং বাকি দু’জনকে উদ্ধার করে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়ার পর তাদেরও মৃত্যু হয়। ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে এক পথচারীও। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে প্রায় ৩৭ লাখ নির্মাণ শ্রমিক। রাজধানীতে বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ভবনে কোন ধরনের জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয় না। নির্মাণ শ্রমিকরা বহুতল ভবনে অরক্ষিত অবস্থায় কাজ করে। যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় আশপাশের মানুষও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায় ভবন নির্মাণের কাজ করার সময় পড়ে গিয়ে শ্রমিক নিহত হচ্ছে। হতদরিদ্র ওসব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা দেয়ারও কেউ নেই। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকার কারণে কোন শ্রমিকের মৃত্যু হলে ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের তার দায় নেয়ার কথা। অথচ ডেভেলপার বা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে কোন দায় নিচ্ছে না। আবার জাতীয় বিল্ডিং কোডে কর্মকালীন একজন শ্রমিকের কী কী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। আর বিষয়টি তদারক করার দায়িত্ব যাদের, তারাও এ ব্যাপারে উদাসীন। ফলে নিরাপত্তা উপেক্ষিত থাকায় প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১৪ সালের জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী কাজের সময় শ্রমিকের মাথায় হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। যারা কংক্রিটের কাজে যুক্ত, তাদের হাতে গ্লাভসও পরতে হবে। চোখের জন্য ক্ষতিকর কাজ যেমন ড্রিলিং, ওয়েল্ডিং, ঢালাইয়ের সময় শ্রমিকদের চশমা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। ওয়েল্ডার ও গ্যাস কাটার ব্যবহারের সময় রক্ষামূলক সরঞ্জাম যেমন গ্লাভস, নিরাপত্তা বুট, এপ্রোন ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে ভবনের উপরে কাজ করার সময় শ্রমিকের নিরাপত্তায় বেল্ট ব্যবহারও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু এর কোনটিই বাস্তবে দেখা যায় না। ফলে দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতিনিয়ত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে হতাহত নির্মাণ শ্রমিকদের আনা হয়। এক্ষেত্রে মৃত্যুর চেয়ে পঙ্গুত্ববরণ করার ঘটনাই বেশি। উঁচু ভবন থেকে পড়া, মাথায় ইট পড়া, রডসহ ভারিবস্তু পড়া, ভবনের পাশে হেঁটে যাওয়ার সময় কোন কিছু পড়ার ঘটনা বেশি। তার মধ্যে মাথায় আঘাতপ্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
এদিকে গত ১১ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর ভাটারায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে দুই শ্রমিক নিহত হয়েছে। তারা ১৪ তলা নির্মাণাধীন ভবনের ৯ তালার বাইরের অংশে মাচাংয়ে দাঁড়িয়ে পলেস্তারের কাজ করছিল। হঠাৎ মাচা ছিড়ে দুজন নিচে পড়ে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় দু’জনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জররুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। গত ২৩ জুন ক্যান্টনমেন্ট পশ্চিম মানিকদি এলাকায় নির্মাণাধীন একটি ভবনের নয় তলা থেকে নিচে পড়ে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। পশ্চিম মানিকদি নির্মাণাধীন ভবনের নয় তলায় রডের কাজ করার সময় অসাবধানতাবশত ওই শ্রমিক ওপর থেকে নিচে পড়ে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অন্যদিকে নির্মাণকাজ করতে গিয়ে একের পর এক দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্মাণ কাজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য শ্রমিকরা দাবি জানিয়েছে। কারণ ভবন নির্মাণকাজে নিরাপত্তার মারাত্মক অভাব রয়েছে। ভবনের মালিক পক্ষ বা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও কোনো শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেয়া হয় না। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই জীবিকার তাগিদে শ্রমিকদের নির্মাণ কাজ করতে হচ্ছে। ফলে ভবন নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ই বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এর দায়দায়িত্ব ভবন মালিকপক্ষ বা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিচ্ছে না। এমনকি দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক মারা গেলে বা আহত হলেও কেউ দায় নিতে চায় না। ফলে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় নির্মাণ শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস-এর কনসালট্যান্ট খন্দকার আ. সালাম দৈনিক জানান, রাজধানীসহ সারাদেশের ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে যে আইন রয়েছে তার প্রয়োগ ও তদারকি নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের নিরাপত্তায় নির্মানাধীণ ভবন মালিক বা শ্রমিকদের সাথে কোন ধরনের সমন্বয় করে না। ভবন মালিক বা ভবন নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা শ্রমিকদের কাজ করার সময় নিরাপত্তা সামগ্রী দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা পালন করা হয় না। তাছাড়া নির্মাণ শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে।