দেশজুড়ে অগ্নি দুর্ঘটনা বৃদ্ধিতে প্রাণ ও সম্পদহানি বাড়ছে

0
369

খুলনাটাইমস এক্সক্লুসিভ: দেশজুড়েই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অগ্নি দুর্ঘটনার ঘটনা। তাতে প্রাণ ও সম্পদহানিও বেড়ে চলেছে। শুধুমাত্র চলতি বছরের প্রথম এগারো মাসে সারাদেশে ২২ হাজারেরও বেশি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যা গত ২৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ওসব অগ্নি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ২শ’ কোটি টাকারও বেশি সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। যা একটি সভ্য দেশে কোনক্রমেই কাম্য নয়। বিগত ১৯৯৬ সালে দেশজুড়ে ৫ হাজার ৩৭৬টি অগ্নি দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬৩ কোটি টাকা। তার ১৩ বছর পর ২০০৯ সালে তা বেড়ে ১২ হাজার ১৮২টিতে দাঁড়ায়। ওসব অগ্নিকা-ে ১১৮ জন নিহত হয়। তার প্রায় ১০ বছর পর ২০১৯ সালের প্রথম ১১ মাসে ২২ হাজার ২৮৩টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। যা সর্বকালের সর্ব রেকর্ড ভঙ্গ করে। এভাবে অগ্নি দুর্ঘটনা চলতে থাকলে দেশে প্রতিবছরই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বর্তমানে প্রতিটি অগ্নিকা- মানেই কোটি কোটি টাকার ক্ষতি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শহর ও গ্রামে যত্রতত্র অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও পুরনো বৈদ্যুতিক সংযোগ হালনাগাদ না করা, জনসচেতনতা না থাকা, সরকারের ফায়ার আইন কার্যকরে বাধা ও চলমান আইনের নানা ত্রুটি রয়েছে। তাছাড়া অগ্নি দুর্ঘটনায় দেশে আইন থাকলেও কোনো আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ফায়ার সার্ভিসের মামলা করার ক্ষমতা নেই। শুধুমাত্র নোটিস দিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সতর্ক করা ছাড়া আর কোন কিছু করতে পারে না। ফলে মানুষজন অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কোনো নির্দেশ ও উপদেশ মানতে আগ্রহী হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, বর্তমানে শহর বা গ্রামের মানুষের ব্যবহার্য জিনিসের ব্যাপক পরিবর্তন আসায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা খুবই কম সময়ে আগুন নেভাতে পারছে না। বরং আগুন লাগলেই তা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এক সময় নাগরিকরা কাঠের তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার করতো। ফলে আগুন লাগলে পানি ছিটানোর সঙ্গে সঙ্গেই আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। বর্তমানে মানুষ অতি আধুনিক পদার্থের তৈরি আসবাব ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে। ফলে আগুন লাগলে অগ্নি নির্বাপক কর্মীরা ফোম দিয়েও আগুণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। এমনকি অগ্নি দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ করতে অতি উন্নতমানের আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন যন্ত্রপাতি আনা এবং দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়েও কোনক্রমেই অগ্নি দুর্ঘটনা রোধ ও ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ কমানো যাচ্ছে না। পাশাপাশি কারো কারো মতে দেশজুড়ে অগ্নি দুর্ঘটনা ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার সক্ষমতার অভাবও অনেকটা দায়ি।
সূত্র আরো জানায়, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশজুড়ে ছোট-বড় মোট ২২ হাজার ২৮৩টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। যার সংখ্যা ৩ হাজার ১৭৭টি। এগারো মাসের অগ্নি দুর্ঘটনায় ২০৩ কোটি ৯২ লাখ ৭৬ হাজার ৩১৫ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের চেষ্টায় ১ হাজার ৬৯৪ কোটি ৫২ লাখ ২০ হাজার ১২০ টাকার সম্পদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অথচ ১৯৯৬ সালে সারাদেশে মোট ৫ হাজার ৩৭৬টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬৩ কোটি টাকা। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৯৭ সালে ৫ হাজার ৮০২টি, ১৯৯৮ সালে ৫ হাজার ৩টি, ১৯৯৯ সালে ৫ হাজার ২০৭টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। তাছাড়া ২০০০ সালে ৫ হাজার ৩১৫টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ৯৭১টি, ২০০২ সালে ৫ হাজার ৪০৪টি এবং ২০০৩ সালে তা বেড়ে গিয়ে ৬ হাজার ২৮৯টি। পরের বছর ২০০৪ সালে তা আরো বেড়ে গিয়ে ৭ হাজার ১৪০টিতে দাঁড়ায়। কিন্তু তার পরের বছর ২০০৫ সালে ৫ হাজার ৪৭৫টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এই দশ বছরে অগ্নি দুর্ঘটনায় হতাহতের কোনো তথ্য দিতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস অধিদফতর। তাছাড়া ২০০৬ সালে ৯ হাজার ৫৪২টি অগ্নি দুর্ঘটনায় আহত ৮৭৩ জন, নিহত ৯১ জন। ২০০৭ সালে ৯ হাজার ১৯৬টি অগ্নিকা-ে আহত হন ১ হাজার ৪৫৫ জন ও নিহত হন ১৬০ জন। ২০০৮ সালে ৯ হাজার ৩১০টি অগ্নিকা-ে নিহত হন ২২৯ জন, আহত হন ১ হাজার ৩৫৬ জন। ২০০৯ সালে ১২ হাজার ১৮২টি অগ্নিকা-ে নিহত হন ১১৮ জন। ২০১০ সালে ১৪ হাজার ৬৮২টি অগ্নিকা-ে প্রাণ হারান ৬৩ জন। তাছাড়া ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৮১৫টি অগ্নিকা-ে নিহত হন ৩৬৫ জন। পরের বছর ১৭ হাজার ৫০৪টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২১০ জন। ২০১৩ সালে অগ্নি দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৯১২তে। নিহত হন ১৬১ জন। পরের বছর ১৭ হাজার ৮৩০টি অগ্নি দুর্ঘটনায় ৭০ জন প্রাণ হারান। ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৮৮টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৬৮ জন। পরের বছর ১৬ হাজার ৮৫৮টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫২ জন। ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নি দুর্ঘটনায় মারা যান ৪৫ জন। পরের বছর সর্বোচ্চ ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৩০ জন। তবে চলতি ২০১৯ সালে ওসব রেকর্ড ভেঙ্গে যায়। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে ২২ হাজার ২৮৩টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। যা সর্বকালের সর্ব রেকর্ড ভঙ্গ করে। এভাবে অগ্নি দুর্ঘটনা চলতে থাকলে দেশে প্রতিবছরই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বর্তমানে প্রতিটি অগ্নিকা- মানেই কোটি কোটি টাকার ক্ষতি।
এদিকে অগ্নিকান্ডের কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ম না মেনে ভবন বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা, কোন স্থাপনা নির্মাণ করার পর যেসব কারণে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তার কোন প্রকার পরিকল্পনা না থাকা। এমনকি কোন কোন প্রতিষ্ঠান শুরুর পর থেকে কর্মরতদের কখনো আগুন লাগলে কিভাবে তা প্রতিরোধ করতে হবে বা কোন কোন পদ্ধতিতে সহজেই অগ্নি দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব তার সামান্যটুকু প্রশিক্ষণ পর্যন্ত দেয়া হয় না। তাছাড়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীগণ নিয়মিত বিভিন্ন ভবনে অগ্নি মহড়া প্রদান করলেও প্রতিষ্ঠান মালিকগণ সে বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেন না। ফলে অগুন লাগলেই বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে মহাবিপত্তি ঘটে। আর আগুনে পুড়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয় ও বেঘোরে হারায় কত তরতাজা প্রাণ।
অন্যদিকে অগ্নি আইন না মানার কারণে এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কোন প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা জরিমানা আদায় করতে দেখা যায়নি। ফলে ভবন মালিকরা সহজে অগ্নি আইন মানতে আগ্রহী হচ্ছে না। যার পরিণাম সাধারণ নাগরিকদেরকে জীবন দিয়ে ভোগ করতে হয়। যদিও বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস অধিদফতর প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নি মহড়ার সংখ্যা ও জনসচেতনতা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে অতি দ্রুত পাল্লা দিয়ে বিশাল আকৃতির ভবন বা স্থাপনা নির্মাণ করা হলেও অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর তেমন কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয় না। এমনকি অগ্নি আইনে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি নেয়াও বাধ্যতামূলক নয়। ফলে নিজ ইচ্ছামতোই অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়। তবে অগ্নি আইনের কঠোরতা ও নাগরিকদের অগ্নিসংশ্লিষ্ট উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান, ফায়ার সার্ভিসের জনবল বৃদ্ধি, উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদান, রাস্তার পাশে ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা, শহর ও গ্রাম পর্যায়ে অগ্নি প্রতিরোধে আলোচনা সভা সেমিনারের আয়োজন ও সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগ্নিনিরোধক আধুনিক যন্ত্রপাতির সংযোজন ও এর সঠিক ব্যব্হারই পারে অগ্নি দুর্ঘটনার হার কমাতে।
এ বিষয়ে জানতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন জানান, অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে নাগরিকদের মাঝে অধিক পরিমাণে সচেতনতা বৃদ্ধি করাই মূল কাজ। তা নাহলে অগ্নি দুর্ঘটনা কোনক্রমেই রোধ করা সম্ভব হবে না। একসময় সারাদেশে মাত্র ৩০ জনের মতো ওয়্যারহাউস পরিদর্শক থাকলেও বর্তমান সরকারের সহায়তায় তা ২শ’ ৬৮ জনে পৌঁছেছে। তাছাড়া যে কোন প্রকার অগ্নি দুর্ঘটনায় কাজ করতে ফায়ার সার্ভিসের জনবলও বর্তমান সরকার বাড়িয়েছে। যদিও তা পর্যাপ্ত নয়। অথচ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে দ্রুত উন্নয়ন ঘটছে। ছোট বড় বহুতল স্থাপনা ও ভবন নির্মাণও বাড়ছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগ্নি দুর্ঘটনাও বাড়ছে। এক সময় নিয়ম মেনে ভবন তৈরি করা হলেও বর্তমানে অনেক ভবন দুর্বল ও নিম্নমানের ক্যাবল দিয়ে ঘরের ওয়্যারিংয়ের কাজ করা হয়। তাছাড়া যে কোন ভবনেরই স্বাভাবিক ক্ষমতার চেয়ে বেশি লোডের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করাও আগুন লাগার অন্যতম কারণ। তাছাড়া গ্যাসের চুলা ব্যবহার করার পর তা ভালভাবে বন্ধ না করা, দাহ্য পদার্থ দিয়ে ভবনের ভেতরে ডেকোরেশন করায় আগুন লাগলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এসবের ব্যবহার কমাতে হবে। পাশাপাশি অগ্নি নির্বাপণ আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার জন্য সরকারের ও অগ্নি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করা হচ্ছে। তবে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভবন বা স্থাপনা নির্মাণের পর অগ্নিরোধে ব্যবস্থা নেয়া ও যন্ত্রপাতি স্থাপন করা, নিয়মিত মহড়া দেয়া ও আগুন লাগার কারণ চিহ্নিত করে তা দ্রুত নেভাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে দুর্ঘটনা বর্তমানের তুলনায় অনেকাংশে কমে আসবে।