দাকোপে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে স্বপ্ন

0
1357

আজিজুর রহমান, দাকোপ থেকে :
এবড়োখেবড়ো গ্রামীণ মেঠোপথ ধরে এগোতে এগোতে হঠাৎ বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে তৈরি দুই চালা ঘরের ভেতর সবুজের সমারোহ চোখে পড়ার মতো। সেখানে একপা দুপা হেঁটে এগিয়ে দেখা গেল প্রলয় মজুমদারের টমেটোখেত। দুই চালা ওই ঘরের ভেতর লাল-সবুজ রঙের টমেটো এখন স্বালম্বীর স্বপ্ন তাঁর। ওই এলাকায় টমেটো চাষের খ্যাতি আছে। কিন্তু সেটা শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে নয়, শীতে টমেটোর ভরা মৌসুমে।

টমেটো মূলত শীতকালীন সবজি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু টমেটো এখন শুধু শীতকালেই নয়, গরমেও চাষ হচ্ছে। চলতি মৌসুমে খুলনার দাকোপ উপজেলায় লবণাক্ত জমিতে চাষ হয়েছে গ্রীষ্মকালীন টমেটো। বাঁশ ও জাল দিয়ে তৈরি দুই চালা ঘরের ভিতরে টমেটো ফুলের মৌ মৌ গন্ধের স্বপ্নে বিভোর প্রলয়।

প্রায় চার বছর ধরে সবজি চাষের পাশাপাশি শীত মৌসুমে টমেটো চাষ করতেন উপজেলার কৈলাশগঞ্জ গ্রামের চাষি প্রলয় মজুমদার। তিনি বলেন, শীতকালীন টমেটো নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক গাছ মারা যায়। এ ছাড়া একসাথে প্রচুর টমেটো বাজারে থাকায় মৌসুমে দাম পড়ে যায় বলে তেমন লাভ থাকে না। লাভের আশায় হঠাৎ করেই তিনি টমেটো চাষের নতুন প্রযুক্তির সন্ধান পান। গ্রাফটিং করে টমেটোর চাষ শুরু করেন। বাঁশের খুঁটি, পলিথিনের চাল দিয়ে তৈরি ঘরে টমেটো চাষ করলে ঝড়-বাদল তেমন ক্ষতি করতে পারে না। বন টমেটোর গাছের সঙ্গে গ্রাফটিং করে চারা তৈরির প্রযুক্তিও শিখে নিয়েছেন প্রলয়। তাই শীতকালীন টমেটোর চাষ ছেড়ে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ শুরু করেছেন তিনি।

প্রলয় মজুমদার জানান, একটি চারা তৈরিতে তাঁর খরচ হয় চার টাকার মতো। জৈষ্ঠ্যের শেষের দিকে চারা রোপণ করেছেন। ৪০ দিনের মধ্যেই গাছে টমেটো ধরেছে। গাছে গাছে এখন ঝুলে আছে কাঁচা ও আধকাঁচা টমেটো। তিনি জানান টমেটোর পোকা দমনে কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করেননি। রাসায়নিক ছাড়াই গাছের পাকা টমেটো তিনি বাজারে তুলবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শীত মৌসুমে এখানে প্রায় ৬০ লাখ টাকার টমেটো বেচাকেনা হয়। সে সময় আগাম বাজার ধরার জন্য কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা হয়। এই সুবিধা পেতে কৃষকেরা অপুষ্ট টমেটো পাকানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকেন। আগাম টমেটোর চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এবার উপজেলাতে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ করা হয়েছে।

কৃষক প্রলয় মজুমদারের জমিতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর ২০ শতক জমিতে প্রায় দুই হাজার পাঁচ‘শটি গাছ রয়েছে। রোপণের পদ্ধতি অনুযায়ী, জমিটি ছয় হাত চওড়া ও ২০ হাত লম্বা ১০টি সারিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রতি দুই সারির মাঝখানে যাতায়াতের রাস্তা। ছয় ফুট ওপরে পলিথিন দিয়ে ছাউনি করে দেওয়া হয়েছে। গাছগুলো কাঠি দিয়ে সোজা করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি থেকে রক্ষা করা এবং মাটিতে পড়ে যাতে গাছ ও ফল পচে নষ্ট না হয়, সে জন্য এ ব্যবস্থা।

মাঠে ছিলেন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা হিরন্ময় কুন্ডু। তিনি জানান, গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জন্য ছাউনির বাড়তি খরচটুকু করতে হয়। তবে শীতের টমেটোর জন্য যে পরিমাণ সেচ দিতে হয়, গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জন্য তার প্রয়োজন পড়ে না। গড়ে পুষিয়ে যায়। তিনি জানান, এই খেতে পোকা দমনের জন্য কোনো ধরনের বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়নি। এখানে প্রতি শতককে তিনটি করে ৫০টি ফেরোমন ফাঁদ টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত এই ফাঁদের কৌটায় পানি ও ডিটাজেন্ট মিশিয়ে দেওয়া হয়। পোকা উড়ে এসে কৌটায় বসে আর উড়তে পারে না। সে জন্য পোকা দমনে আলদা খরচ লাগছে না। তিনি জানান, শুধু ফুলে একটা হরমোন ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা ব্যবহার করলে ফলন দ্বিগুণ হয়। বীজতলায় চারার বয়স এক মাস হলে তুলে জমিতে রোপণ করতে হয়। গত ২৩ মে জমিতে চারা রোপণ করা হয়েছে। রোপণ থেকে শুরু করে আট মাস পর্যন্ত এর ফলন পাওয়া যাবে। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ এই এলাকায় বেশ ভাল সাড়া পড়েছে। প্রলয়ের মতো আরও কয়েকজন কৃষক টমেটোর চাষও করেছে।

প্রলয় জানান, তাঁর ২০ শতক জমিতে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি শীতকালেও টমেটোর চাষ করেন। তখনো প্রায় এই ধরনের খরচ পড়ে। কিন্তু তখন ব্যাপক উৎপাদন হওয়ায় ভালো দাম পাওয়া যায় না। তিনি আশা করছেন, গ্রীষ্মকালীন টমেটোতে ভালো দাম পাবেন।

দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান খুলনাটাইমসকে বলেন, যশোরে সর্বপ্রথম এই জাতের টমেটোর চাষ শুরু হয়। এবার দাকোপের ১২জন কৃষককে এই টমেটো চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় এক একর জমিতে আধুনিক পদ্ধতিতে বিষমুক্ত টমেটো চাষ করেছে। এখন টমেটো চাষে খরচ কম কিন্তু দাম বেশি। এছাড়া সারা বছর সবজির চাহিদা পূরণ করতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে কৃষককে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের দারিদ্র্য দূরীকরণেও এই ফসল বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।