জোয়ারের পানিতে পাইকগাছায় পৌরসভা সহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত, স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা!

0
156

নিজস্ব প্রতিবেদক:
খুলনার পাইকগাছায় ঘুর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারে নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বুধবার সকাল থেকে কোথাও ঝুকিপূর্ণবেড়িবাঁধ ভেঙ্গে, আবার কোথাও বাঁধ উপচে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে বিভিন্ন এলাকা। এছাড়া নদ-নদীতে স্রোতের তোড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে নদীভাঙ্গন। ফলে চলতি ইয়াসসহ আসন্ন বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সামনে রেখে চরম ঝুকির মধ্যে রয়েছে উপকুলীয় জনপদের সাধারণ মানুষ। অতিদ্রুত বাঁধের ঐ এলাকাগুলো সংষ্কার না হলে সেখানকার লক্ষ লক্ষ মানুষের ব্যাপক ক্ষতি সাধেেনর আশংকা করছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়দের অভিযোগ, আম্ফান পরবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ ওয়াপদার বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় একরকম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।

সরেজমিনে দেখাগেছে, উপজেলার আগড়ঘাটা বাজার সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ, রাড়ুলী ইউপি’র রাড়ুলী জেলে পল্লীর নিকটবর্তী বেড়িবাঁধ, গদাইপুরের বোয়ালিয়া ব্রীজ নিকটবর্তী বেড়িবাঁধ, লতায় শিবসা নদীর ভেড়িবাঁধ, দেলুটির চকরি বকরি এলাকায় শিবসা নদীর ওয়াপদার বাঁধে ভাঙ্গন, সোলাদানা বাজার, বেতবুনিয়া আদর্শ গ্রাম, গড়ইখালীর খুদখালী ভাঙ্গন কবলিত এলাকা দিয়ে হুহু করে গ্রামের ভেতর পানি ঢুকছে। এ ছাড়া পাইকগাছা পৌরসভাসহ ১০ টি ইউনিয়ের অধিকাংশ ওয়াপদা উপছে দ্রুত পানি ঢুকছে। ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে, চিংড়ী ও মৎস্য ঘের। নষ্ট হচ্ছে কাঁচা পাকা রাস্তা, বাড়ি ঘর। এব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বিশ্বাস জানান, বাঁধের ভয়াবহ অবস্থার ব্যাপারে কয়েক দফায় উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করলেও কার্যত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। চেয়ারম্যান আরোও জানান, বাঁধের অবস্থা খারাপ হওয়ায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী নিজে উপস্থিত থেকে কর্মসৃজন প্রকল্পের কর্মসূচির লোক দিয়ে বাঁধ মেরামতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘই্র বাঁধ মেরামত করা হয়ে যাবে। তবে সেটি পুরোপুরি ঝুকি মুক্ত নয়। ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী মিজানুর রহমান মিজান বলেন, এই মুহুর্তে ভাঙ্গন ঢেকাতে না পারলে জোয়ারে পানি বৃদ্ধি পেলে কিংবা ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাতে গড়ইখালী ইউনিয়ন সহ পার্শ্ববর্তী অনেক এলাকা প্লাবিত হবে। দেলুটির ইউপি চেয়ারম্যান রিপন কুমার মন্ডল জানান, ইউনিয়নের জিরবুনিয়ার চৌমূহনী, দেলুটির শিবসা নদীর পাশে, ২২ নং পোল্ডারের দারুন মল্লিক, কালীনগর, তেলেখালি, দূর্গাপুর ও বিগরদানার বাঁধ মারাত্মক ঝুকিপুর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
শিক্ষক সুকৃতি মোহন সরকার জানিয়েছেন, জোয়ারের পানির তোড়ে মঙ্গলবার বেলা ১টার দিকে চকরিবকরি প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে গেলে কর্মসৃজন কর্মসুচির লোকজন ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় সেটি আপাতত মেরামত করা গেছে। তবে সেটি শঙ্কামুক্ত নয়। লতা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান কাজল কান্তি বিশ্বাস জানিয়েছেন, ইউনিয়নের উত্তরকাঠামারী, লতা ও ধলাই এলাকার বাঁধ ব্যাপক ঝুকির মধ্যে রয়েছে। সোলাদানা ইউপির চেয়ারম্যান এস এম এনামুল হক জানান, তার ইউনিয়নের নুনিয়াপাড়া, হরিখালীর বাঁধ মারাত্মক ঝুকিপুর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এদিকে সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য আব্দুল মান্নান গাজী জানান, সোলাদানা ইউনিয়নের ২৩নং পোল্ডারের পাটকেল পোতা, আমুড়কাটা স্লুইচ গেট, বাসাখালী ও পতন, বেতবুনিয়া ও সোলাদানার আবাসন এলাকার আঁধা কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। গদাইপুরের ইউপি চেয়ারম্যান গাজী জুনায়েদুর রহমান জানান, ইউনিয়নের বয়রা, বাইশারাবাদ, হিতামপুর ও পুরাইকাটী এলাকার আঁধা কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ।
রাড়–লীর ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল মজিদ গোলদার জানান, ইউনিয়নের ৯নং পোল্ডারের মালোপাড়া ও ভড়ভুড়িয়ার গেট এলাকার ১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে দুপুরের কপোতাক্ষ নদের জোয়ারের পানি উপচে মালোপাড়া তলিয়ে যায়। লস্করের ইউপি চেয়ারম্যান কেএম আরিফুজ্জামান তুহিন জানিয়েছেন ভড়েঙ্গারচক গেট, বাইনতলা, আলমতলা হাটখোলা, আলমতলা দক্ষিণ বিলের গেট, লস্করের বাইনতলা খেয়াঘাট থেকে কড়–লিয়া ব্রিজপর্যন্ত ওয়াপদার বাঁধ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। যে কোন সময় বাঁধ ভেঙ্গে গোটা ইউনিয়ন প্লাবিত হতে পারে। ইতোমধ্যে স্থানীয় লোকজনদেরকে সাথে নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে।
কপিলমুনি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ কওছার আলী জোয়াদ্দার জানান, বুধবার সকালে অতিরিক্ত জোয়ারের পানির চাপে কপিলমুনি ও হরিঢালী ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকা কপোতাক্ষের বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের সদস্যরা ও স্থানীয় এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। কপিলমুনি ইউনিয়নের আগড়ঘাটা ও মালতে কিছু অংশ এবং পার্শ্ববর্তী হরিঢালী ইউনিয়নের কপোতাক্ষ তীরবর্তী হাবিবনগর, পাররামনাথপুর, দরগামহল ও মামুদকাটি এলাকা বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলেও জানান তিনি। এব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দীন জানান, উর্দ্ধতন কতৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ’র ভিত্তিতে ঐসকল এলাকায় বাঁধের কাজ শুরু করা হবে। প্রসঙ্গত, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবেলায় এবং জানমাল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি রোধে উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ১০৮টি আশ্রয় কেন্দ্র, পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশ, সিপিপি, স্বেচ্ছাসেবক ও স্কাউটস সদস্যদের। ফসল ও ফল-মুলের ক্ষয়ক্ষতি রোধে সতর্ক ব্যবস্থা নিয়েছে কৃষি বিভাগ। মজুদ রাখা হয়েছে, নগদ অর্থ, চাল, শুকনা খাবার, গো-খাদ্য, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও জরুরী যানবাহন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী জানিয়েছেন, আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৌরসভা সহ ১০টি ইউনিয়নকে গুরুত্ব দিয়ে সকল প্রকারের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। তবে গড়ইখালী, দেলুটি, সোলাদানা, লস্কর ও চাঁদখালী সহ কয়েকটি ইউনিয়ন অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেগুলোকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই সাধারণ মানুষ যাতে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে আশ্রয় কেন্দ্রে যায় সে জন্য সকল এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। মানুষ ও গবাদি পশুদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ৫৯ হাজার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ১০৮টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্যোগ পূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ের জন্য থানা পুলিশের পাশাপাশি প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২ হাজার সিপিপি সদস্য, ১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক, ৩শ গ্রাম পুলিশ ও আনসার, চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত আছে বিশেষ মেডিকেল টিম, ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীও প্রস্তুত রয়েছে।

আশ্রয় কেন্দ্রে আনা নেওয়ার জন্য এ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য যানবাহন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের যানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে থানা পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে বলেও থানা ওসি এজাজ শফী জানিয়েছেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস জানান, দুর্যোগ কালীন সময়ের জন্য নগদ টাকা, চাল, শুকনা খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও মেশিন এবং পর্যাপ্ত গো-খাদ্য মজুদ রাখা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ নীতিশ চন্দ্র গোলদার জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ও ৫টি মোবাইল মেডিকেল টিমসহ সর্বমোট ১৫ টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া এ্যাম্বুলেন্স, পর্যাপ্ত জরুরী ঔষধ, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু জানিয়েছেন, তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় থেকে ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। উপজেলা প্রশাসনসহ দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার বাঁধ মেরামতের কাজ নিজে উপস্থিত থেকে তদারকি করছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী জানান, বেড়িবাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কথা অবগত হয়েই তিনি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের সাথে নিয়ে অধিক ঝুকিপূর্ন এলাকায় বাঁধ সংরক্ষণের প্রাথমিক ব্যাবস্থা নিয়েছেন। তাছাড়া মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ এলাকা থেকে লোকজন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বেড়িবাঁধ রক্ষায় ভাঙ্গন প্রতিরোধে টেশসই ও স্থায়ী সমাধানে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। তবে স্থানীয়দের অভিমত, এই মুহূর্তে ভাঙ্গন ঠেকাতে না পারলে পুর্ণিমার জোয়ার কিংবা ঘুর্ণিঝড় “ইয়াসের” প্রভাবে পাইকগাছা উপজেলার গড়ইখালী, লস্কর, চাঁদখালী, ও কয়রা উপজেলার আমাদী ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের লাখ লাখ মানুষ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এছাড়া মাছের ঘেরসহ জান-মালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হবে বলেও আশংকা করছেন স্থানীয়রা।