শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সবার প্রত্যাশা

0
682

দেশে যেকোনো নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। যেকোনো নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের পর শারীরিক নির্যাতন, সম্পদ ধ্বংস, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া যেন এক নিষ্ঠুর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জন্য। আমরা তা প্রতিরোধ করতে পারছি না আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারার জন্য, পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা করতে না পারার জন্য এবং নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার জন্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা খুব অল্প সময় পেয়েছি গণতন্ত্র চর্চা করার জন্য, পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা করার জন্য। দীর্ঘ সময় স্বৈরাচারের জাঁতাকলে পিষ্ট বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য চেষ্টাও করা হয়নি সেভাবে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্য গণতন্ত্রকে নিজেদের ভাষায় ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। আমাদের মাঝে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে, আমাদের মাঝে পরমতসহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে সেই পরিবেশ আমরা পাইনি, সে পরিবেশ সৃষ্টিও করা হয়নি। একেক সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং একেকভাবে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যার জন্য সঠিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চর্চা এখানে অনুপস্থিত ছিল দীর্ঘদিন। এর একটি বড় কারণ ছিল, আমরা গণতন্ত্রে নিজেদের সব সময় জয়ী দেখতে চাই। পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা আমাদের গড়ে ওঠেনি। ক্ষমতার বাইরে আমরা নিজেদের কল্পনা করতে খুব একটা অভ্যস্ত নই। এটা আমাদের জাতীয় সমস্যা।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সময় এগিয়ে যাচ্ছে, দেশ নির্বাচনমুখী হচ্ছে। আর কিছুদিন অর্থাৎ এ বছরের শেষে অথবা নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সময়ে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কাজ চলছে সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট কী হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি, তার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। তবে সবাই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করছে, এমনকি আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরাও চাইবে এবারের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি। গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব বিষয় বিবেচনার গুরুত্ব রয়েছে। তবে এই সব কিছুর সঙ্গে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো নির্বাচনী সহিংসতাকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে ঠেকানো, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নির্বাচন-পূর্ববর্তী ও নির্বাচন-পরবর্তী হামলা প্রতিরোধে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে। এটি করতে না পারলে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর হতে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা কতটুকু নিজেদের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাভাজন করতে পেরেছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা আমাদের একটি বড় ব্যর্থতা। প্রতিটি নির্বাচনে সহিংসতা ঘটতে দেখা যায়। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরদিন পর্যন্ত। সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে ভোটদান থেকে বিরত থাকার জন্য ভয়ভীতি দেখানো এবং নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতাই বেশি হয়ে থাকে।

ভোট-পরবর্তী সহিংসতার একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে, যে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ব্যাপক হারে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এ পর্যায়ে নির্বাচনী সহিংসতার একটি বড় কারণ প্রতিশোধ গ্রহণ। বিজয়ী প্রার্থী পূর্ববর্তী ক্ষোভের কারণে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা চালান। শক্তিশালী পরাজিত প্রার্থীও ক্ষেত্রবিশেষে বিজয়ী প্রার্থীর ওপর এবং তাঁর সমর্থকদের ওপর হামলা চালান। নষ্ট করেন তাঁদের ফসল, আগুন লাগিয়ে দেন বাড়িঘরে। ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ছিল বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। এ ধরনের সহিংসতা রোধ করতে না পারলে মানুষের নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে থাকে। আলোচিত এসব সহিংসতা বন্ধে সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সর্বোপরি ভোটারসহ সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ অত্যাবশ্যক। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছাও অপরিহার্য। চাইলে নির্বাচন কমিশন দৃঢ় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। মাঠপর্যায়ে সব রাজনৈতিক দল সহিংসতা দমনে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে পারে। নাগরিক সমাজের সংগঠন ও গণমাধ্যম প্রতিরোধ কমিটির কার্যক্রমে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

নাগরিক সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সহিংস এলাকা চিহ্নিত করতে পারে। এই সংগঠনগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে সেসব এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা, সম্ভাব্য সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করা। নির্বাচনী সহিংসতা প্রতিরোধে গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু জাতীয় গণমাধ্যম নয়, স্থানীয় গণমাধ্যমও এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা সম্ভাব্য সহিংসতা সৃষ্টির বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে আগাম তথ্য দিতে পারেন। নির্বাচনী সহিংসতা প্রতিরোধে ভোটারদের গণ-উদ্যোগ জরুরি, বিশেষ করে প্রাক-নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা প্রতিরোধে ভোটারদের এই গণ-উদ্যোগ কার্যকর হতে পারে।    সূত্র-কালের কন্ঠ